আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে। তারপর অর্থনীতিতে গতি ফিরবে—এমনটিই মনে করা হচ্ছে ব্যবসায়ী মহলে। অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যেন নিশ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু হাঁটতে পারছে না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগে স্থবিরতা, মূল্যস্ফীতির চাপ ও আস্থাহীনতার ঘূর্ণিতে আটকে গেছে উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধির গতি। নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে না—এমন মত প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ী, নীতিনির্ধারকসহ সবাই। কেউই এর বাইরে না।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় থাকলেও নির্বাচিত সরকারের দাবি জোরালো হচ্ছে। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না ফিরলে নতুন উদ্যোগ ও বিনিয়োগ সম্ভব নয়। অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতার কারণে অর্থনীতি এখন এক ধরনের ‘অপেক্ষার ঘূর্ণিতে’ আটকে আছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের পরবর্তী কিস্তি ছাড়া হবে না। একইভাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ঝুঁকি নিতে অনাগ্রহী।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক আস্থা হারানোয় বিনিয়োগ স্থবির, কর্মসংস্থান সংকুচিত, প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেছে। তাদের মতে, “অর্থনীতি টিকে থাকে রাজনৈতিক আস্থার ওপর—সেই আস্থা ফিরিয়ে আনাই সরকারের দায়িত্ব।”
তারা আরও জানান, মাঠের বাস্তবতায় কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে স্থবিরতা ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি অর্থনীতির অস্থিরতাকে বাড়াচ্ছে। ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমেছে ৬.৫ শতাংশে— যা স্বাভাবিক সময়ের প্রায় অর্ধেক। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশ, যা ভবিষ্যৎ শিল্প উৎপাদনের জন্য উদ্বেগজনক।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা প্রমাণ করে মানুষ সঞ্চয় ভেঙে চলতে বাধ্য হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিনিয়োগ এখন শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক আস্থারও প্রশ্ন। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও সহিংসতা উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করছে।
অর্থনীতিবিদদের একাংশ সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে ‘সংস্কার-নাটক’ বলে আখ্যা দিয়ে বলছেন, বাস্তবে ভোগ, বিনিয়োগ ও সরকারি ব্যয়ে কোনও পরিবর্তন আসেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, “অতীত সরকারের প্রবৃদ্ধির মডেলে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব তৈরি হয়েছিল। তথাকথিত অর্থনৈতিক অলৌকিকতার গল্পের আড়ালে লুকিয়ে ছিল কঠিন বাস্তবতা। এখন সেই বাস্তবতাই প্রকাশ্যে এসেছে।”
তিনি বলেন, ‘‘মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, দারিদ্র্য বেড়েছে, এবং আরও ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। বর্তমানে দেশে ১৩ লাখ তরুণ-তরুণী বেকার, স্নাতক পর্যায়ের প্রতি তিনজনের একজন কর্মহীন।’’
তিতুমীরের মতে, “বাংলাদেশ এখন ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। হয় আমরা এই স্থবিরতা মেনে নেবো, না হয় নতুন অর্থনৈতিক মডেলের পথে এগোবো।”
বিনিয়োগে স্থবিরতা, আস্থাহীন ব্যবসায়িক পরিবেশ: পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ মনে করেন, বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব বাংলাদেশের অন্যতম বড় দুর্বলতা। “দেশে কোনও জাতীয় বিনিয়োগনীতি নেই, ফলে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য ও দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত,” বলেন তিনি।
ব্যবসায়ী মহলে এখন আস্থার সংকট প্রকট। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নির্বাচিত সরকারের অনুপস্থিতিতে নতুন উদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এখন সবাই অপেক্ষায়—আইএমএফ, উন্নয়ন সহযোগী, বিদেশি বিনিয়োগকারী, এমনকি দেশীয় উদ্যোক্তারাও।
অর্থনীতিবিদরা এই অবস্থাকে বলছেন ‘অপেক্ষার ঘূর্ণি’, যেখানে রাজনৈতিক আস্থা না ফেরায় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে না।
আইএমএফের শর্তে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অগ্রাধিকার: বাংলাদেশ ২০২২ সালে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে। ঋণের পাঁচ কিস্তি ইতোমধ্যে ছাড় হয়েছে। কিন্তু ষষ্ঠ কিস্তি এখনও ঝুলে আছে। সংস্থাটি স্পষ্ট জানিয়েছে, নতুন সরকার গঠনের পরই তারা অর্থ ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি শুধু আর্থিক নয়, রাজনৈতিক আস্থার বিষয়ও।
রিয়েল এস্টেট খাতের সংগঠন রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়া বলেন, “ম্যানুফ্যাকচারিং, রিয়েল এস্টেট, ব্যাংকিং ও সেবা খাতে নতুন বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। আইএমএফ এখন অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক আস্থার সংকট দেখছে।”
এফবিবিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক ইসহাকুল হোসাইন আরও স্পষ্টভাবে বলেন, “নির্বাচিত সরকার ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নেওয়া আত্মহত্যার মতো ঝুঁকি। বিদেশি ক্রেতারাও এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন, ফলে রফতানি অর্ডার কমছে।”
বিজিএমইএ’র জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান মনে করেন, “সাময়িক সরকারের ওপর আস্থা কম থাকে। তাই আইএমএফ ও বিদেশি অংশীদাররা নতুন সরকারের অপেক্ষায়, তখনই আস্থা ও বিনিয়োগ বাড়বে।”
বিদেশি বিনিয়োগে পতন, পুঁজি পাচারের আশঙ্কা: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ২২ শতাংশ কমেছে। নতুন প্রকল্প নিবন্ধন প্রায় বন্ধ। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী এখন ‘অপেক্ষার পর্যায়ে’, কেউ কেউ পুরোনো কারখানা সংকুচিত করছেন। এমনকি কেউ কেউ বিদেশে সম্পদ স্থানান্তর করছেন—যা অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক সংকেত।
পরিকল্পনা কমিশনের জেনারেল ইকোনমিক্স ডিভিশন (জিইডি) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৩৫ শতাংশ, যা ইতিহাসের অন্যতম নিম্ন হার। বিপরীতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ১৬.৫৯ শতাংশ। কারণ বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। ফলে বেসরকারি খাতের অর্থের জোগান কমে গেছে।
‘অর্থনীতি নিশ্বাস নিচ্ছে, হাঁটতে পারছে না’: বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) প্রেসিডেন্ট আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো— নির্বাচন নিয়ে স্পষ্টতা ও আস্থা পুনর্গঠন। সরকারকে দ্রুত জানাতে হবে— নির্বাচন কবে হবে এবং সেটি যেন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়।”
তিনি বলেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং সরকার-ব্যবসায়ী সম্পর্কের আস্থা না ফিরলে বিনিয়োগ সচল করা সম্ভব নয়।’’
অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা ও নীতির অস্বচ্ছতা: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি বলেন, “সরকার যদি নীতিতে পূর্বানুমান যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতো, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব এত গভীর হতো না।”
অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, “সুদের হার এখনও ১৩-১৪ শতাংশের মধ্যে। নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। টাকার প্রবাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, ফলে বিনিয়োগ পরিবেশ দুর্বল থাকবে।”
ইতিবাচক উদ্যোগ, কিন্তু পুনরুদ্ধার টেকসই নয়: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় অর্থনীতি ছিল নাজুক। তবে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ এবং রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও টেকসই পুনরুদ্ধারের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।”
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণহীন, ভোগ ও সঞ্চয়ে ধস: বিবিএসের তথ্যমতে, আগস্ট ২০২৫-এ গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৬ শতাংশ—গত বছরের তুলনায় সামান্য কম হলেও বাস্তব অর্থে তা নিয়ন্ত্রণে নয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতি ২.১, পাকিস্তানের ৩ এবং শ্রীলঙ্কার মাত্র ১.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় ও ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রিও ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি কমেছে—যা প্রমাণ করে মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খরচ চালাচ্ছে।
দারিদ্র্য ও সামাজিক সংকট বৃদ্ধি: সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যের হার ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা আগের পুরো বছরের সমান হয়ে গেছে মাত্র ছয় মাসেই। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, এক গভীর সামাজিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত।
একজন বিশ্লেষক ব্যঙ্গ করে বলেন, “যে দেশে ৩৬৫ দিনে ৩৭০টি মব সন্ত্রাস ঘটে, সে দেশে পাগলও বিনিয়োগ করবে না।”
রিজার্ভে কিছু অগ্রগতি, তবু আশঙ্কা: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ পুনর্গঠনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটির এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের উপপরিচালক থমাস হেলব্লিং বলেছেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা সঠিক দিকেই যাচ্ছে।” আইএমএফের প্রতিনিধি দল আগামী ২৯ অক্টোবর ঢাকায় এসে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে। ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির শুরুতে ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের সম্ভাবনা থাকলেও সংস্থাটি স্পষ্ট করেছে— নির্বাচিত সরকার গঠনের পরই তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
তৈরি পোশাক খাতে বড় ধাক্কা: ১৮ অক্টোবর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫১৬টি পোশাক কারখানার স্যাম্পল পুড়ে যায়, ফলে আনুমানিক ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিজিএমইএ বলছে, প্রকৃত ক্ষতি এর চেয়ে দ্বিগুণও হতে পারে।
বিজিএমইএ সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান বাবলু বলেন, “স্যাম্পল পুড়ে যাওয়ায় রফতানি অন্তত এক মাস পিছিয়ে যাবে। আগুনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, কাপড়ের মান যাচাই নমুনা ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ারের ডকুমেন্টও নষ্ট হয়েছে।”
‘অর্থনীতি আইসিইউ থেকে কেবিনে’, নাকি আবার সংকটে?
সরকারের এক উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন, “অর্থনীতি আইসিইউ থেকে কেবিনে গিয়ে এখন বাড়ি ফিরছে।” তবে বাস্তব সূচকগুলো বলছে উল্টো কথা—বিনিয়োগে স্থবিরতা, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্যের বৃদ্ধি অর্থনীতিকে আবারও বিপজ্জনক সীমানায় ঠেলে দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ—অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা, যাতে রাজনৈতিক আস্থা ফিরে আসে এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে এগোয়। উৎস: বাংলাট্রিবিউন।