শিরোনাম
◈ নির্বাচনের জন্য ঘেরাও করা লাগলে, এটা হবে দুর্ভাগ্যজনক: সালাহউদ্দিন আহমদ  ◈ গাইবান্ধায় দুই হ্যাকারের বাড়িতে অভিযানে যা পেলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (ভিডিও) ◈ সরকারের ভেতরে-বাইরে অস্থিরতা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে: তারেক রহমান ◈ রাজধানীর যেসব এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করল ডিএমপি ◈ বাজারভিত্তিক হার চালুর ৩ দিনের মাথায় ডলারের দাম বাড়ল ◈ ঢাকাসহ ১১ জেলায় রাত ২টার মধ্যে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে ◈ বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে পোশাক আমদানি বন্ধ করলো ভারত ◈ ভারত-পাকিস্তান সংকটে ইউনূসের সতর্ক কূটনীতি ◈ নাশকতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগে বরখাস্ত সৈনিক নাইমুল গ্রেফতার ◈ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে চাঙ্গা বিএনপি ও এনসিপি!

প্রকাশিত : ১৭ মে, ২০২৫, ০৮:১৪ রাত
আপডেট : ১৮ মে, ২০২৫, ১২:৩৬ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কলমবিরতি বনাম কাঠামো পরিবর্তন: এনবিআর বিতর্কে উত্তপ্ত পরিস্থিতি

অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামের দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকার থেকে বলা হয়েছে, এর মূল লক্ষ্য হলো করনীতি প্রণয়ন ও কর ব্যবস্থাপনার কাজ আলাদা করা। একইসঙ্গে দক্ষতা বাড়ানো, স্বার্থের সংঘাত হ্রাস ও দেশের কর ভিত্তি প্রসারিত করা। তবে এনবিআর বিলুপ্তির প্রতিবাদে কলমবিরতির ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সামষ্টিক অর্থনীতির এই ক্লান্তিকালে কেনো এনবিআর বিলুপ্তি করা হলো, তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভেতর বাহির ও সংশ্লিষ্টরা নানা মন্তব্য করছেন।

বিলুপ্তির বিষয়ে সরকার যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে সেই লক্ষ্য অর্জন করা কতটুকু সম্ভব— জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাহাদাত সিদ্দিকী চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রাতহিবলের (আইএমএফ) পরামর্শে এনবিআর বিলুপ্ত করা হয়েছে। আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার বিলম্বের কারণও ছিলো এ সংস্কার, তাই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ ধরণের কার্যক্রম রয়েছে। কিন্তু এটি ভেঙে দিতে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বিশেষ করে স্টেক হোল্ডাদের পরামর্শ নেয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিন্দুমাত্র পরামর্শ নেয়া হয়নি।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত যখন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানে না, তখন এটিকে আমরা বলি একধরনের গভর্নমেন্ট ফেইলিউর। স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে না রেখে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তখন কো অর্ডিনেশন ফেইলিউর হয় এবং এর ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

অধ্যাপক ড. মো. সাহাদাত সিদ্দিকী আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে রেভিনিউ পারফরমেন্স, রেভিনিউ জেনারেশন পারফরমেন্স ঋণাত্মক। আমরা রেভিনিউ সংগ্রহের ক্ষেত্রে অলরেডি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। এখন যদি কোঅর্ডিনেশন ফেইলিউর হয়, তখন আরও বড় ধাক্কা লাগবে। হঠাৎ করে কিছু চাপিয়ে দিলে সেটির প্রভাব ভালো হয় না। কাস্টমস ও শুল্কসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্মতারা এটিকে গ্রহণযোগ্য মনে করবে না।

অর্থনীতিতে আন্দোলনের প্রভাব
একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে অধ্যাপক ড. মো. সাহাদাত সিদ্দিকী বলেন, আন্দোলনের কারণে শুধু বেনাপোল বন্দরে দৈনিক ২০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে ঘাটতি বাজেটের মধ্যে সরকারের আরও রাজস্ব ঘাটতি হবে। রাজস্ব খাতের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া এনবিআর বিলুপ্ত করায় রাজস্বখাতকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।

যেভাবে কর জিডিপি বৃদ্ধি করা যায়

তিনি বলেন, কর জিডিপি বৃদ্ধির বিষয়ে আইএমএফ এর পরামর্শ রয়েছে। এ খাতে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এজন্য রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আলাদা করা হয়েছে। তবে এ প্রক্রিয়াটি যদি আইএমএফ এর ঋণ নেয়ার শুরু থেকে সংস্কার করা যেতো, তাহলে সুন্দর সমাধান হতো। রাষ্ট্রের কর জিডিপি দেখে বুঝা যায়, কি পরিমাণ লুটপাট চলছে। এদেশে একশ্রেণির ধনীরা সরকারকে লুটে খাচ্ছে। এটির জন্য এনবিআর এবং করকর্তৃপক্ষের দায় রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের তিন কোটি মানুষ ট্যাক্সের অধীনে আসা উচিৎ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব মতে, গত অর্থবছর শেষে দেশে টিআইএন ধারী ছিল এক কোটি চার লাখ মানুষ। দেশের মানুষের আয় বাড়লেও করদাতা বাড়ছে না কেনো এটি একটি বড় প্রশ্ন। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন সরকারের এক হুংকারে ৮৮ লাখ মানুষ টিআইএন ধারী হয়েছে। কিন্তু অন্তর্বতী সরকার তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি।

অধ্যাপক ড. মো. সাহাদাত সিদ্দিকী বলেন, দেশে ২৬ লাখ মানুষ কর দেন। বছরের পর বছর ২৬ লাখ রয়ে গেলো, এ সংখ্যা বাড়ছে না। জিডিপি বাড়াতে হলে করদাতা বাড়াতে হবে। বাকিরা কেনো ট্যাক্স দেয় না, সেটি বের করতে হবে। বিগত সরকার এবং তার আগের সরকারও ভ্যাট বৃদ্ধি করেছে, মানুষ তা সহ্য করছে। এটি গরিবদের জন্য মারণাস্ত্র। সরকারি হিসাব মতে, ১৯ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে। দেশে অতি দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। যার ফলে ভাত ও পুষ্টিকর খাবার আগের চেয়ে কম খায় মানুষ। এ অবস্থায় দেশে রাজস্ব ঠিক করতে ভ্যাট বাড়ানো হয়। যদিও জনরোষের ভয়ে কিছুটা পিছু হটেছে সরকার।

সরকারের উদ্দেশে অধ্যাপক তিনি বলেন, আপনাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। প্রত্যক্ষ কর কেনো বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার। যদি তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি মানুষ থেকে কর আদায় করা যায়,  তাহলে করজিডিপি বাড়বে। এটি সরকারের জনপ্রিয়তা অর্জনের বড় একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। কর জিডিপি বাড়াতে প্রত্যক্ষ করের নীট যেটা আছে, সেটাকে বৃদ্ধি করা। এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের জিডিপির পরিমাণ ধীরে ধীরে যেভাবে কমে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে রাজস্ব প্রবৃদ্ধির যে প্রত্যাশার কথা বলা হচ্ছে, সে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। কোভিডের পর জিডিপি সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া গেলো ৬ বছরের তুলনায় বিনিয়োগ পরিস্থিতিও সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আগামী বাজেট বর্তমান বাজেটের সমানও দিতে পারবে না। যদি ঘাটতি বাজেট দেয়া হয়, তাহলে গেলো সরকারের সঙ্গে এ সরকারের পার্থক্য থাকে না। বাংলাদেশের বাজেটের ব্যয়ের ডাবল আয় হতে পারে, যদি ঠিকভাবে প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ করা হয়। এজন্য ব্যবস্থাপনা ও নীতিগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি। রাজস্ব বাড়াতে হলে ব্যবসায় বাড়াতে হবে, লেনদেন বাড়াতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমদানি-রপ্তানি সব জায়গায় থেকে সরকারের আয় আসে। মানুষ মনে করে, এ দেশে যেহেতু ট্যাক্স না দিয়েই থাকা যায়, বাড়ি করা যায়, গাড়ি করা যায় সবই করা যায়, তাহলে কেনো ট্যাক্স দেবো। এজন্য কর ফাঁকি দাতার বিরুদ্ধে কঠিন অ্যাকশন নিতে হবে।

ভূমি ক্রয়-বিক্রয় থেকে রাজস্ব আহরণ: ধ্যাপক ড. মো. সাহাদাত সিদ্দিকী বলেন, গুলশান-বনানীতে এক কাঠা জায়গা দশ থেকে বিশ কোটি টাকাও দাম আছে। কিন্তু রেজিস্ট্রির সময় প্রকৃত মূল্য দেখানো হয় না। এভাবে ব্ল্যাক মানি তৈরি হয়। এটি বন্ধ করতে পারলে সরকার রাজস্ব খাতে লাভবান হবে। বছরের পর বছর যারা ট্যাক্সের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে  না, তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কর আহরণে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পুরো দেশকে সরকারের সুপারভিশনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে আর ঘাটতি বাজেট দিতে হবে না এবং সামষ্টিক অর্থনীতির ক্লান্তিকালও দূর করা সম্ভব। এজন্য শুধু নতুন বিভাগ গঠন নয়, নীতির বাস্তবায়ন করা জরুরি।

এনবিআর বিলুপ্তির যে ব্যাখ্যা দিলো সরকার: এনবিআর বিলুপ্তের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এনবিআর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ; এটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। বিশ্বে কর-জিডিপির গড় অনুপাত ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি মালয়েশিয়ায় এই অনুপাত ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে অন্তত ১০ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত অর্জন করতেই হবে।

কর-জিডিপির অনুপাতের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআর পুনর্গঠন জরুরি। একই সংস্থা করনীতি প্রণয়ন এবং সেই নীতির বাস্তবায়ন করবে—এ অবস্থান সাংঘর্ষিক। সেই সঙ্গে এটা ব্যবস্থা হিসেবে অদক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে দেশের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন, নীতি প্রণয়নে রাজস্ব আহরণকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে; ন্যায়বিচার, প্রবৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা উপেক্ষা করা হয়েছে।

এনবিআর ভেঙে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠন শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়; বরং ন্যায়ভিত্তিক ও দক্ষ করব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। শক্তিশালী নীতি নির্ধারণ ও স্বচ্ছ প্রশাসন বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বপ্নপূরণে সহায়ক হবে। উৎস: চ্যানেল২৪

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়