শাহাজাদা এমরান / হৃদয় হাসান, কুমিল্লা: বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা। কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় মোড়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে সারি সারি অবৈধ ইজিবাইক। কর্কশ হর্নের শব্দে চারপাশ মুখর, অথচ গাড়ি চলছে থেমে থেমে। অফিসগামী মানুষ, স্কুলগামী শিশু—সবার মুখে অস্থিরতার ছাপ। ফুটপাত দখল হয়ে গেছে হকার ও দোকানের পসরা দিয়ে।
রাজগঞ্জ, কান্দিরপাড়, চকবাজার ও শাসনগাছ রেলগেটসহ নগরের প্রধান সড়কগুলো সকাল থেকেই যানজটে জর্জরিত। ফুটপাত দখলের কারণে পথচারীরা বাধ্য হয়ে মূল সড়কে নেমে চলাচল করছেন, যা গাড়ির গতিকে আরও মন্থর করে দিচ্ছে। সড়কের দুই পাশে যত্রতত্র পার্কিং, অটোরিকশায় যাত্রী তোলা, প্রাইভেটকার দাঁড় করিয়ে রাখা, পণ্যবাহী ভ্যানের লোড-আনলোড—সব মিলিয়ে রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
রাজগঞ্জ থেকে আদালতপাড়া যেতে যেখানে ১০ মিনিট সময় লাগার কথা, সেখানে এখন সময় লাগে প্রায় ৩০ মিনিট। বিকল্প গলিপথও ভিড়ে ঠাসা, ছোট ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল মাঝেমধ্যে আটকে যাচ্ছে রাস্তায়।
দুপুর ১২টার দিকে চকবাজার এলাকায় যানজট ভয়াবহ রূপ নেয়। বাজারের ভিড়, পণ্যবাহী ভ্যান, ইজিবাইক ও রিকশার চাপে রাস্তার চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। চকবাজার থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত মাত্র এক কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টার বেশি। অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়েও দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু সামনের যানবাহন সরতে পারে না।
বিকেল ৩টার দিকে স্কুল-কলেজ ছুটি হলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ঢল নামে রাস্তায়। অনেক অভিভাবক গাড়ি বা মোটরসাইকেল রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করেন, এতে সড়কের অর্ধেক জায়গা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। অপর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে; অনেক রাস্তায় তাদের উপস্থিতিই নেই।
প্রশাসন মাঝে মাঝে অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা ও নির্দিষ্ট সড়কে ইজিবাইক নিষিদ্ধের অভিযান চালালেও কিছুদিন পরেই আগের চিত্র ফিরে আসে। বর্তমানে নগরে প্রায় ৬০ হাজার ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলছে, যার বড় অংশ নিবন্ধনবিহীন। সংকীর্ণ সড়ক, পার্কিং সংকট ও বিকল্প গণপরিবহন না থাকায় মানুষ ছোট যানবাহনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কুমিল্লার সড়ক নকশা তৈরি হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন জনসংখ্যা ও যানবাহনের চাপ ছিল তুলনামূলক কম। কিন্তু এখন জনসংখ্যা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম কয়েকগুণ বেড়েছে, অথচ সড়কের প্রস্থ বা বিকল্প রুট বাড়েনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আদালতপাড়া ও বাজার একই এলাকায় হওয়ায় চাপ সবসময় থাকে।
নগরবিদ ড. আহসান কবির বলেন, “যানজট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি—বিকল্প গণপরিবহন চালু, স্মার্ট ট্রাফিক সিগন্যাল ও আধুনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সড়ক সম্প্রসারণ ও বিকল্প রুট, নির্দিষ্ট পার্কিং জোন এবং নিবন্ধনবিহীন ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।”
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে ১১০ কিলোমিটার পাকা সড়ক থাকলেও অর্ধেকেরও বেশি এলাকায় সারাদিন যানজট লেগে থাকে। এর প্রধান কারণ হলো—অবৈধ পার্কিং, ফুটপাত দখল, অতিরিক্ত ইজিবাইক-অটোরিকশা, সড়কের নির্মাণকাজ এবং ট্রাফিক পুলিশের অপ্রতুল জনবল।
কুমিল্লা জেলা ট্রাফিক ইন্সপেক্টর সারোয়ার মো. পারভেজ বলেন, “আমাদের লোকবল তীব্র সংকটে আছে। বর্তমানে ৭৯ জন ট্রাফিক পুলিশ দিয়ে কাজ চলছে, যেখানে অন্তত ২০০ জন প্রয়োজন।”
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন বলেন, “যানজট নিরসনে জেলা প্রশাসনের একটি কমিটি কাজ করছে। আমরা মূলত ফুটপাত দখলমুক্ত করতে অভিযান চালাই।”
তবে স্থানীয় নাগরিকদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক পুলিশ উভয়েই দায়িত্ব পালনে অদক্ষ ও ব্যর্থ। দৈনিক কুমিল্লার জমিন-এর সম্পাদক শাহাজাদা এমরান বলেন, “প্রতিটি আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে যানজট নিয়ে কথা বলি, কিন্তু সিটি করপোরেশন ও পুলিশের প্রতিনিধি দায়সারা উত্তর দেন। কাজের কাজ কিছুই হয় না। অবস্থা না বদলালে নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় নামা ছাড়া বিকল্প নেই।”