সোহাগ হাসান জয়, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: পরীক্ষা এলেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় সিরাজগঞ্জের সালেহা ইসহাক সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে পড়তে হয় বাধ্যতামূলক কোচিং বা প্রাইভেট। আর নির্দিষ্ট শিক্ষকদের কাছে পড়লেই পাওয়া যায় সেই পরীক্ষার প্রশ্ন ও প্রত্যাশিত নম্বর। জানাজানি হলে কিছুদিন হইচই চলে। তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। যেন এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টির শিক্ষার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এদিকে শিক্ষারমান নিম্নমুখী হওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে অভিভাবকসহ সিরাজগঞ্জ শহরবাসী।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) দুপুরে সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গেলে ক্ষোভ প্রকাশ করে এভাবেই কথাগুলো বললেন কয়েকজন অভিভাবক। তাদের ভাষ্য, কয়েক বছর ধরেই বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক প্রশ্ন ফাঁস করে আসছেন। আর পড়তে বাধ্য করছেন শিক্ষকদের কোচিং সেন্টারে। এ চক্রের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগও দেওয়া হয়েছে। লোক দেখানো তদন্ত কমিটি হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণেই অভিযুক্ত শিক্ষকরা আরও বেপরোয়া হয়ে কোচিং বাণিজ্যে জড়িত হচ্ছেন। আর বছরের পর বছর প্রশ্নফাঁস করে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটিকে। দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ অন্যত্র বদলী করা না হলে বিদ্যালয়টি আরো ক্ষতির মুখে পড়বে বলে দাবী অভিভাবকদের।
অভিযোগ থেকে জানা গেছে, গত জুন মাসে ষান্মমাসিক পরীক্ষা শুরুর আগের দিন ইসলাম ধর্ম বিষয়ের শিক্ষক মো. কামরুজ্জামান, গণিত শিক্ষক সামান আলী শেখ, ভৌত বিজ্ঞান শিক্ষক তৈমুর হাসান, বাংলা শিক্ষক লিলি খাতুন ও আবুল কাশেম প্রশ্ন ফাঁস করেন। তাদের কাছে পড়েন এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই সব প্রশ্ন সরবরাহ করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও জেলা প্রশাসকসহ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হয়। অভিযোগ পেয়ে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ৩ সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যেই তদন্তে নেমেছে। গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযুক্ত শিক্ষকদের আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
অভিযোগে আরও জানা যায়, বিদ্যালয়ে ২০০২ সালে গণিত শিক্ষক হিসেবে সামান আলী শেখ, ২০১০ সালে বাংলা শিক্ষক লিলি খাতুন, ২০১৬ সালে ভৌত বিজ্ঞানে লিলির স্বামী শিক্ষক তৈমুর হাসান, ২০১২ সালে ইংরেজি শিক্ষক আবুল কাশেম ও ২০১৭ সালে ইসলাম ধর্মের শিক্ষক কামরুজ্জামান যোগদান করেন। এরা বছরের পর বছর যুগের পর যুগ একই কর্মস্থলে থেকে কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস করে আসছেন।
বিদ্যালয়ে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী প্রশ্নফাঁস সিন্ডিকেট। এদের মধ্যে জেলা আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী সভাপতি হোসেন আলী হাসানের পুত্রা হওয়ায় তৈমুর হাসান ও তার স্ত্রী লিলি খাতুন দীর্ঘদিন আওয়ামীলীগের প্রভাব খাটিয়ে এ প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসলেও তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা। বরং তাদের বিরুদ্ধে যে শিক্ষক প্রতিবাদ করেছে তাকেই হতে হয়েছে বিদ্যালয় থেকে বদলী। এদের প্রভাব ও প্রতিপত্তির কাছে অসহায় হয়েই প্রাইভেট পড়তে বাধ্য থাকতেন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
গত বছর ষান্মমাসিক-বার্ষিক পরীক্ষার আগেও একইভাবে প্রশ্ন ফাঁস করা হয়। সেবারও অভিভাবকরা সাবেক জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে স্থানীয়ভাবে ও রাজশাহী শিক্ষা দপ্তর থেকে পৃথক দুটি তদন্তও করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদনটি আজও আলোর মুখ দেখেনি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁস সংক্রান্ত বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষক মো. কামরুজ্জামান সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই ফোন কেটে দেন। তবে ভৌত বিজ্ঞান শিক্ষক তৈমুর হাসান বলেন, এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি নিয়মনীতি মেনেই আমি দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছি। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সাথে আমি জড়িত নই।
এ বিষয়ে সালেহা ইসহাক সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফসার আলী বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। একাধিকবার তদন্ত হলেও আলোর মুখ দেখেনি। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হলে উল্টো আমাকেই লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করা হয়।
প্রশ্নফাঁস চক্রের শিক্ষকরা এ বিদ্যালয়ে একটি শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তারা বছরের পর বছর ও যুগের পর যুগ একই কর্মস্থলে থেকে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা ও প্রাইভেট না পড়লে মার্ক কম দেওয়াসহ নানা অপকর্ম করলেও অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি ব্যবস্থা। এ কারণেই প্রত্যেক পরীক্ষার আগেই প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসকসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। গত জুন মাসে অভিভাবকরা আবারও অভিযোগ দিয়েছেন। এবারও বিষয়টি লিখিতভাবে জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে আমি যতবার সোচ্চার হয়েছি, ততবারই তাদের রোষানলে পড়েছি। এখনও তাদের হুমকি-ধামকিতে নিজেই জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আর আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওইসব অভিযুক্ত শিক্ষকদের কাছে বন্দি হয়ে পড়েছে।
ওই অভিযুক্ত শিক্ষকরা যেকোন সময়ে আমাকে প্রাণনাশসহ জীবনের বড় ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যেই আমার নিরাপত্তার স্বার্থে বিদ্যালয় থেকে বদলী হওয়ার জন্য আবেদন করেছি। আমি জীবনের নিরাপত্তার চেয়ে এক/দুই দিনের মধ্যেই থানায় জিডি করবো।
পরিচালনা পর্ষদ সভাপতি ও জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম বলেন, লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।