হাসান মোরশেদ: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন মাত্র কয়েকটি বিষয়, সবই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক। পরীক্ষার রেজাল্ট অনুযায়ী যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমি সাস্টে ভর্তি পরীক্ষা দিইনি। মনে আছে ভর্তি ফরম জমা দেওয়ার শেষদিনে সাস্টে পড়া এক বড় ভাই ফরম নিয়ে এসে রীতিমতো জোর করেছিলেন, সেই ভাই এখন পুলিশের নামকরা সুপার। আমি সাস্টে পড়িনি কারণ আমার জেদ চেপেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো এবং নো মোর বিজ্ঞান, পড়বো বিজনেস নিয়ে। সাস্টে বিজনেস ফ্যাকাল্টি আসছে অনেক পরে। সদ্য গণতান্ত্রিক সময়ে প্রবল সন্ত্রাসে জর্জরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি পরিবারের একমাত্র পুত্রকে, সেই ক্ষোভে আর কোথাও ভর্তি পরীক্ষা না দিয়ে সরাসরি ভর্তি হয়েছিলাম বিজনেস ম্যানেজমেন্টে- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এক কলেজে। ভালোই পড়েছিলাম বলে মনে হয়। ইংল্যান্ডে এমবিএ করতেও অসুবিধা হয়নি, অনেক বছর পর বহু আকাক্সক্ষার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ারও সুযোগ হয়েছে।
সাস্টে আমার যে বন্ধুরা পড়েছিলো তাদের কেউ কেউ সাস্টেই এখন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নিত হয়ে গেছে। দেশে ফেরার পর সাস্টের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপচারিতা, মোটামুটি ঘনিষ্ঠতা এবং ভালো বন্ধুত্বও হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ পূর্ণ অধ্যাপক আছেন, বিভাগীয় প্রধানও আছেন। অপরদিকে বিয়িং এ সিলেটি- সাস্টে ছাত্র হিসেবে জুনিয়র আত্মীয় স্বজন অনেকেই আছে। লেখক হিসেবে অতি সামান্য কিছু পরিচয় তৈরি হয়েছে বলে, সাস্টের ছাত্রদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে লেখালেখি সূত্রে মতবিনিময়ের সুযোগও প্রায়শ হয়। একটা অদ্ভুত বিষয় বেশ কিছুদিন থেকেই আমাকে প্রবল পীড়া দিচ্ছিলো। দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানি না। সার্বিকভাবে এদেশে শিক্ষার মান, মানুষের গুণগত মানের প্রবল পতন ঘটেছে- এটা সব ক্ষেত্রেই। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পরিস্থিতি তেমন ভালো থাকার কথা নয়, কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে মন্তব্য করা উচিত নয়।
তবে সাস্টের দুপক্ষ- শিক্ষক এবং ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছে বলে বুঝতে পেরেছি এখানকার পরিস্থিতি। কোনো এক অদ্ভুত কারণে সাস্টে শিক্ষক- ছাত্রদের সম্পর্কে স্রেফ ঘৃণার। কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে। কিন্তু গড়পরতা সম্পর্ক আসলে ঘৃণারই। এই অকল্পনীয়, অনাকাক্সিক্ষত ব্যাপারটি কেন ঘটেছে, কবে থেকে শুরু হয়েছে- আমি জানি না। বিয়িং এন আউটসাইডার আমার অতাা ডিটেইলস জানার কথা নয়। কোনো পক্ষ এক তরফা দায়ী কিনা সেটাও জানি না। কিন্তু সাস্টের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে স্নেহ ও শ্রদ্ধাবোধ তো নেইই, স্বাভাবিক ভদ্রতার সম্পর্কও নেই। বরং সেটা যে পারস্পরিক সন্দেহ ও ঘৃণার সেটা মোটামুটি সত্য। আজকের পরিস্থিতি একদিনে হুট করে তৈরি হয়নি। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এই চরম অবনতি, মানসিক দূরত্ব তৈরি হওয়ার মেকানিজম নিয়ে বোধ হয় আলাদা গবেষণার সুযোগ আছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, বাংলাদেশের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পারস্পরিক ঘৃণার পরিবেশ নেই। দুবছর পর আমার সন্তানও বিশ্ববিদ্যালয়গামী। এই পরিবেশ নিয়ে আমি আতঙ্কিত।
লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :