নিউজ ডেস্ক: নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে দলীয় নেতাকর্মীদের একাংশের অসহযোগিতা ও বিরোধিতা, নানা বাধা বিপত্তি এবং অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আবারও মেয়র পদে বিজয়ী হলেন সেলিনা হায়াত আইভী। গতকাল রবিবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে ৬৯ হাজার ১০২ ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়েছেন নৌকার এই প্রার্থীর। আর এর মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো নাসিক মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়লেন তিনি।
নির্বাচনে ১৯২টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে সবগুলো কেন্দ্রের বেসরকারি ফলাফল পাওয়া গেছে। এতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভী নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১ লাখ ৬১ হাজার ২৭৩ ভোট। অন্যদিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার হাতি প্রতীকে পেয়েছেন ৯২ হাজার ১৭১ ভোট। অর্থাৎ ৬৯ হাজার ১০২ ভোট বেশি পেয়ে তৈমুর আলম খন্দকারকে পরাজিত করেন আইভী। রাত আটটার দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের পাশে অস্থায়ী দপ্তরে ভোটের এই ফল ঘোষণা করেন নাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার।
নির্বাচিত হওয়ার পর সেলিনা হায়াত আইভী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে তাকে বিজয়ী করার জন্য ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘এ বিজয় জনতার বিজয়। এ বিজয় সকল প্রকার অন্যায় অবিচার আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিজয়।’ তার বিজয়ে যারা সহযোগিতা করেছে ভোটারদের পাশাপাশি তাদের প্রতিও আইভী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আধুনিক নারায়ণগঞ্জ গড়তে আমি সকলের সহযোগিতা চাই।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রার্থীর হিসাবে আধুনিক নারায়ণগঞ্জ গড়তে সকল প্রকার সহযোগিতা পাবেন এমন বিশ্বাস রেখে নাসিক নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রতিও তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর তৈমুর আলম খন্দকার রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সেলিনা হায়াত আইভীর বিজয়ে অভিনন্দন না জানালেও ভোট গ্রহণকালেই বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণের রায় আমি মেনে নেব।’
সেলিনা হায়াত আইভী দেশের সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে প্রথম নারী মেয়র। ২০০৩ সালে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে তাকে দল মনোনয়ন দিলে সেই সময় ক্ষমতাসীন দল বিএনপির প্রার্থী নূরুল ইসলাম সরদারকে পরাজিত করে পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আইভী। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান শামীম ওসমান। আইভী নাগরিক ঐক্যের প্রার্থীর হয়ে শামীম ওসমানকে পরাজিত করেন। এরপর গতকাল টানা তৃতীয়বারের মত মেয়র নির্বাচিত হলেন তিনি।
এবারের নির্বাচন সেলিনা হায়াত আইভীর জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। মনোনয়ন যাতে না পান এ জন্য তার বিরুদ্ধে চলেছে নানা ষড়যন্ত্র। বিভিন্ন অপপ্রচার চলেছে তার নিজ দল থেকেই। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে তৃণমূল থেকে তার নাম না পাঠালেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেলিনা হায়াত আইভীকে মনোনয়ন দেন। এরপর অদৃশ্য শক্ররা বিভিন্ন কায়দায় তাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। নির্বাচনে আচরণবিধি ভঙ্গের ভয়ে শামীম ওসমান নিশ্চুপ থাকায় বিভিন্ন ধরণের কথাবার্তা ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, বাহাউদ্দিন নাসিম, মীর্জা আজমসহ ১১জনকে নিয়ে নাসিক নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্যরা আইভীর জয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।
তবে শামীম ওসমানের অনুসারীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে প্রচারণায় অংশ নিলেও সেলিনা হায়াত আইভী তাদেরকে বিশ্বাস করতে পারেননি। এমনকি আইভী এক পর্যায়ে বলেন, তৈমুর আলম খন্দকার ওসমান পরিবারের প্রার্থী। দীর্ঘ নিরবতার পর গত ১০ জানুয়ারি শামীম ওসমান আনুষ্ঠানিক ভাবে সংবাদ সম্মেলন করে নৌকার পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন। শামীম ওসমান এই ঘোষণা দেওয়ার পরও আইভী ও তার সমর্থকদের মধ্যে অজানা আতঙ্ক কাজ করে। তবে ঘরে-বাইরের অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেও আইভীর বিশ্বাস ছিল জনতা তার সঙ্গে আছে, এবারও তাকেই বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে।
সেলিনা হায়াত আইভীর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, ১৯৮৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। তাঁর পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ডা. সেলিনা হায়াত আইভী। তিনি রাশিয়ার ওডেসা পিরাগোব মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৯২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯২-৯৩ সালে ঢাকা মিটফোর্ট হাসপাতালে ইন্টার্নি সম্পন্ন করেন। ১৯৯৩-৯৪ সালে একই হাসপাতালে এবং ১৯৯৪-৯৫ সালে নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যার হাসপাতালে অনারারি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদিকা হন। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত।