খুজিস্তা নূর ই নাহারীন
ছেলেমেয়ে ড্রাগ এডিক্ট বিয়ে করিয়ে দাও। ছেলেমেয়ে অসুস্থ বিয়ে করিয়ে দাও। ছেলেমেয়ে রাতে বাড়ি ফিরে না উচ্ছৃঙ্খল বিয়ে করিয়ে দাও। ছেলেমেয়ে চরিত্রহীন বিয়ে করিয়ে দাও। ছেলেমেয়ে প্রচণ্ড ঔদ্ধত্য, অহঙ্কারী, রাগী, কেউ মানাতে পারে না বিয়ে করিয়ে দাও। চারদিকে ভাঙনের সুর বাজে, ইদানীংকার ছেলেমেয়েরা বিয়ে করতে ভয় পায়। বিয়ের পর প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। আপনার নিজের ছেলেমেয়েকে আপনি নিজে সামলাতে বা ঠিক করতে পারছেন না স্বল্প বয়সী অন্য একটি মেয়েছেলের কাঁধে বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ভাবছেন যৌনতাই বুঝি সব কিছুর সহজ সমাধান। কিন্তু আসলে কি তাই? নাকি অন্য একটি মেয়েছেলেকে বিপদে ফেলছেন, মূলত তাঁদের জীবনটা বিষিয়ে তুলে নষ্ট করছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রচÐ প্রেমে বিয়ে কিন্তু দুদিন পরেই কলহ আর পারস্পরিক অভিযোগের পাহাড়। নিষেধের বেড়াজাল নেই বলেই কি তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে নাকি চারপাশের অসুখী দাম্পত্য দেখে দেখে ভীতির সঞ্চার? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেমেরই তো বিয়ে তবু কেন এতো দ্বিধা আর সংশয়? প্রেমের সময় দু’জনে কেবল ভালোলাগাগুলোকেই শেয়ার করে, মন্দগুলো অগোচরেই রয়ে যায়। ক্ষণিকের তরে দেখাশোনায় নিজের ভালোত্বটুকু ঢেলে দেখানো যায় কিন্তু দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থাকলে ‘আমার আমি’ প্রকাশ হতে বাধ্য। দু’জনে দু’জনার প্রতি মোহাবিস্ট হয়ে এমনই পাগল থাকে যে ভবিষ্যৎ আলোচনা করতে ভুলে যায়। কিংবা হয়তো ভাবে বিয়ের পর পরিবর্তন না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয় উল্টোটা। মাত্রাতিরিক্ত প্রেম, ভালোবাসা, আকর্ষণ মানে এই নয় দু’জনে দাম্পত্য জীবনে সুখী হবে। বরং দাম্পত্য এক জটিল সমীকরণ, এক রোমান্টিক চুক্তি যেখানে কেবলই হিসাবের বেড়াজাল।
আবেগ এবং আকর্ষণের চেয়ে বিয়ে পরবর্তী দৈনন্দিন ব্যবহার, জীবনযাপন পদ্ধতি, অভ্যাস, ছোটখাটো চাওয়া-পাওয়াসহ অন্যান্য হিসাবগুলোই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রাত্যহিক রান্না কে করবে, বাজার কে করবে, কাপড় কে ধুবে, ঘর কে গোছাবে কিংবা কীভাবে গোছাবে, ঘুম থেকে জেগে কে আগে চা বানাবে এসব ছোট ছোট ব্যাপারগুলোই তখন অধিক গুরুত্ব বহন করে। আগের দিনের নারীদের চাওয়া-পাওয়া ভীষণ কম ছিলো। স্বামী একটি দামি শাড়ি কিংবা গহনা উপহার দিলেই ভালোবাসা বলে মনে করতো। ক্ষেত্র বিশেষ উপহারও নয় স্বামীর মুখের ভালোবাসার কথা '‘তুমি রূপবতী’ই যথেষ্ট ছিলো। ইদানীংকালে শুকনো কথায় আর চিড়া ভিজে না। শিক্ষিত নারীদের চাওয়া প্রচুর। স্বামীরাও কেবল ঘর সামলাবে এমন নারী নয় বরং সর্ব ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গী হবে এমন স্ত্রী চায়। বিয়ের ক্ষেত্রে কেবল ভালোলাগা বা আকর্ষণের বাইরেও যে বিষয়গুলো আলোচনার প্রয়োজন পারস্পরিক কম্প্যাটিবিলিটি, বোঝাপড়া, মূল্যবোধ, ফিলসফি, নীতি নৈতিকতা তথা মানসিকতা। পাত্র-পাত্রী বিয়ের আগে যে আলোচনাগুলো জরুরি: [১] ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং সন্তান আগমনের প্ল্যানিং। [২] পরিবারে বাবা, মা, ভাইবোন সঙ্গে থাকবে কিনা তাঁদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হবে কিনা। [৩] অর্থনৈতিক কে কী অবদান রাখবে কার পারটিসিপেসন কেমন থাকবে কিংবা আদৌ প্রয়োজন হবে কিনা। [৪] একান্ত চাওয়া-পাওয়া, প্রত্যাশাগুলো নিয়ে আলোচনা। [৫] যতো অপ্রীতিকরই হোক নিজের না জানা গোপন কথা জানিয়ে রাখা নতুবা পরে জানলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েই যায়।
পারস্পরিক স্বচ্ছতা, আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরতা, সম্মান না থাকলে সেই সম্পর্কের কোনো মানে নেই। লুকোচুরি, ছলচাতুরী, অভিনয় বা মিথ্যা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মতো পবিত্র একটি সম্পর্ককে বেশি দূর সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। প্রায় প্রতিটি দাম্পত্যই এক গভীর সুন্দর সম্পর্কের স্বপ্ন আর সেই স্বপ্ন ভঙ্গের নিষ্ঠুর উপাখ্যান। বিয়ে মানেই রাতারাতি আপনার সকল সমস্যার সমাধান নয়, আপনি অনেক সুখী হচ্ছেন ব্যাপারটি এমনও নয়, বিয়ে একটি নতুন জীবনে প্রবেশ, একটি দায়িত্ব। যার জন্য অর্থনৈতিক সামর্থ্য, শারীরিক এবং মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। বিয়ের পর ডিভোর্সে শোনা যায় অনেক ছেলেই ইম্পোটেন্ট অর্থাৎ শারীরিকভাবে অক্ষম। জেনেশুনে অপর একটি মেয়ের জীবন তবে কেন নষ্ট করলেন? অতিরিক্ত প্রেম, দখলদারিত্ব, খবরদারি তথা নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় অপরের জন্য বেদনার কারণ হতে পারে। সবচেয়ে বড় ভুল, ‘বিয়ের পর আমি তাকে বদলাতে পারবো, কিংবা ও’ আমার কথা শুনতে বাধ্য থাকবে’ চিন্তা করা। মূলত মানুষ কখনো বদলায় না। সময়ের প্রয়োজনে নিজেকে হয়তো তৈরি করে, খানিকটা রং বদলায়। উৎসবমুখর পরিবেশে হাসি, খুশি, আনন্দঘন পরিবেশে যে নতুন জীবনের সূত্রপাত তা বহন করা মর্যাদা রাখা এতো সহজ না হলেও অনেক বেশি কঠিনও নয়।
বিয়ে মানে কেবলই আনন্দ উদযাপন বা মধুচন্দ্রিমা নয়, বিয়ে মানে দায়িত্ব আর কর্তব্যের পাহাড়। বিয়ে মানে সবকিছু পছন্দ বা মনের মতো না হলেও মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া, কম্প্রোমাইজ এন্ড এডজাস্টমেন্ট। বিয়ে মানে নিজের কষ্ট আর অপারগতাকে লুকিয়ে রেখে সুখ আর আনন্দ বিতরণের দায়িত। বিয়ে মানে সারাক্ষণ মনে রাখা ‘আমার যেকোনো কর্মকাÐে অপরজন যেন ক্ষতির সম্মুখীন না হয়।’ বাস্তব জীবন কখনো কল্পনার মতো হয় না কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে গেলে কাছাকাছি হয়তো পৌঁছা যায়। এতোগুলো কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য, বিয়ের ক’দিন পরে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা যেন আপনাকে আচ্ছাদিত করতে না পারে। সর্বশেষ আমাদের দেশে বিয়ে মূলত দুই পরিবারের মাঝে হয়। মনে রাখতে হবে পরিবারের গুরুজনদের অতিরিক্ত খবরদারি নবদম্পতির জীবনে অসহনীয় হয়ে অসুখ না বয়ে আনে। তরুণ বয়সী একজন বর/বধূ কিছুতেই আপনার সমান অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নয়, সময় এবং প্রয়োজন তাঁকে তৈরি হতে সাহায্য করবে। অতএব, নবদম্পতির সমস্ত কাজ আপনার মনের মতো না হলেও শোধরানোর সময় দিন, তিরস্কার নয় সহজভাবে বুঝিয়ে বলুন। একটি কার্যকর সুখী দাম্পত্যের জন্য কেবল রূপ নয় সর্বক্ষেত্রে মানিয়ে চলার গুণাবলী এবং যোগ্যতাকেও আমলে নিন। Khujesta Nur-e naharin ’র ফেসবুক ওয়ালে লেখাটি পড়ুন।