অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
পৃথিবীর কোনো একটা ভালো বিশ^বিদ্যালয়ের উদাহরণ দিন যেখানে বিভাগের প্রধানকে বয়সের বা অভিজ্ঞতার জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। পৃথিবীর কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ দিন যেখানে ডিন বা ভিসি শিক্ষকদের ভোটের ভিত্তিতে নিয়োগ পায়। এই দুটোর কোনোটিই বিশ^বিদ্যালয়ের আইডিয়ার সঙ্গে একদমই যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই এখানে সকল কিছু নিয়োগ, অ্যাওয়ার্ড, রিওয়ার্ড, প্রমোশন ইত্যাদি সব কিছু হবে মেরিটের ভিত্তিতে। বয়স বা কে আগে নিয়োগ পেয়েছে সেই ভিত্তিতে সিনিয়রিটি নির্ধারণের স্থান বিশ্ববিদ্যালয় নয়। আবার নির্বাচনের ভিত্তিতে ডিন বা ভিসি নিয়োগতো আরও খারাপ। কারণ মেধাবী এবং যোগ্যরা সাধারণত জনপ্রিয় হয় না। একাডেমিয়াতে জনপ্রিয়তার স্থান নেই কারণ এখানে অনেক অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
৭৩-এর অধ্যাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হলো ভিসি এবং ডিন নিয়োগ পদ্ধতি নির্বাচনের মাধ্যমে করার নীতিমালা। এই নীতিই এই অধ্যাদেশের দ্বারা পরিচালিত ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের ডিগ্রেডেশন বা অধঃপতনের অন্যতম কারণ। ৩ বছরের মেয়াদে বিভাগের নেতা হবে বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক। এখানে কেমন শিক্ষক, কেমন গবেষক ইত্যাদির কোনো উল্লেখ নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ এবং তৎপরবর্তী প্রমোশনগুলো যদি আরও কঠিন নীতিমালার মাধ্যমে হতো তাহলেও অন্তত ভালো মেধাবী শিক্ষকদের সিনিয়র হিসেবে পেতাম। আমাদের প্রমোশনের নীতিমালাগুলোতেও বয়সের অভিজ্ঞতাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। অথচ হওয়া উচিত ছিলো যে কেউ যদি তার চেয়ে বয়সে সিনিয়রের চেয়েও গবেষণার মানদণ্ডে এগিয়ে থাকে তাহলে সেই হবে সিনিয়র। একাডেমিয়াতে বয়সের সিনিয়রিটি কোনো ঐশ্বরিক বিষয় নয় যে তাকে ডিঙানো যাবে না।
যেখানে নির্বাচন সেখানে রাজনীতি ঢুকবেই। ডিন এবং ভিসি নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় রাজনীতি ইঞ্জেক্টেড হয়। আর সিনিয়রিটির ভিত্তিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ মানেই যে নিয়োগ পায় তার মধ্যে এই ভাবনাটি ঢোকানো হয় না আপনি এই পদটি যোগ্যতার ভিত্তিতে অর্জন করেছেন। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগের নেতা নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহন করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিভাগের নেতা নিয়োগের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নিয়োগ বোর্ড থাকে। তারা প্রার্থীর গবেষণা, শিক্ষক হিসেবে কেমন, নেতৃত্বের গুণাবলী কেমন ইত্যাদি নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এমন একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয় যিনি বিভাগের সকলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। যিনি সবাইকে গবেষণা করতে বলতে পারেন। একই কথা প্রযোজ্য ডিন এবং ভিসি-প্রো-ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে। ১০০ বছরে পদার্পণ করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথচ আজও একটি যুগোপযোগী শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রমোশন নীতিমালা, বিভাগের নেতা নিয়োগ, ডিন নিয়োগ পদ্ধতি চালু করতে পারলো না। এমন সব নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে মেধাবীরা কোণঠাসা থাকে, যাতে মেধাবীরা নিয়োগ না পায়। অথচ এসব দেখার কেউ নেই। কেউ বলে না যে এভাবে একটি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।
এক সংবাদে দেখলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মু. আলী আসগর একটি রিট করেছেন। কেন করেছেন? কারণ নিয়ম অনুসারে অর্থাৎ জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তাকে বিভাগের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার কথা কিন্তু প্রশাসন জ্যেষ্ঠতার নিয়ম ভঙ্গ করে জুনিয়র আরেকজনকে নিয়োগ দিয়েছে। দুটো কাজই নজিরবিহীন। এতেই বোঝা যায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নৈতিকতার কোন লেভেলে পৌঁছেছে। তাহলে শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছ থেকে কী শিখবে? যেমনভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চলছে তেমনিভাবে দেশ। লেখক : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন :