গৌতম রায় : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যে প্রসঙ্গটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়, সেটি হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ। ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ও আলোচিত হয় অনেক, কিন্তু সবচেয়ে কম আলোচনা হয় ভর্তি পরীক্ষার মান নিয়ে। প্রথম দুটোকে যদি সাময়িক দুর্ভোগ বা সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তৃতীয়টিকে বিবেচনা করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে, কারণ ভর্তি পরীক্ষা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয়ভাবেই শিক্ষার্থী ও শিক্ষার মানে প্রভাব ফেলে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো ঠিক করে ওঠতে পারেনি যে, ভর্তি পরীক্ষার এই আয়োজন আসলে শিক্ষার্থীদের নির্বাচন করার জন্য, নাকি আসনসংখ্যার বিপরীতে অতিরিক্ত শিক্ষার্থীদের বাদ দেওয়ার জন্য?
দুটো আলাদা উদ্দেশ্য এবং যে কারণে দুটোর জন্য দুই ধরনের চিন্তাভাবনা ও কৌশলের প্রয়োজন। ভর্তি পরীক্ষা যদি শিক্ষার্থী নির্বাচনের কৌশল হয়, সেক্ষেত্রে বলতে হবে, বর্তমান পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, কারণ এই ধরনের প্রশ্নপত্র দ্বারা ও বর্তমানে অনুসৃত প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা মূল্যায়ন করা সম্ভবপর নয়। কী প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নির্বাচন করা যেতে পারে, সেই আলোচনা এখানে করতে চাই না, কারণ নানা ধরনের ও নানা ডিজাইনের চাকা ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে, দরকার শুধু নিজেদের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেওয়া। অপরদিকে ভর্তি পরীক্ষা যদি আসন সংখ্যার অতিরিক্ত শিক্ষার্থীদের বাদ দেওয়ার কৌশল হয়, তাহলে মোটাদাগে বর্তমান পদ্ধতিকে চলনসই বলা গেলেও যেতে পারে, যদিও সেখানেও আরো অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে বরং ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে, লটারি করে বা এরকম আরো নানা পদ্ধতি বের করে শিক্ষার্থীদের বাদ দেওয়া যায়। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ যেমন কমবে, তেমনি ভর্তি পরীক্ষার পেছনে যে শ্রম ও শ্রমঘণ্টা যায়, সেটিরও সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা কলম ও প্রবেশপত্র নিয়ে আসবে, প্রশ্ন দেওয়া হবে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর উত্তরপত্র জমা দিয়ে বের হয়ে যাবে, এই ধারণার বৃত্ত থেকে বের হওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষার্থী কোথায় বসবে, প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা বরাদ্দ আছে কিনা, সেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আছে কিনা, শিক্ষকরা ঠিকমতো পরিদর্শন করতে পারবেন কিনা ইত্যাদি নানা বিষয় পরীক্ষার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয় নিবিড়ভাবে ভাবা প্রয়োজন, কারণ পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ফলাফলের সম্পর্ক রয়েছে। অপরদিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরীক্ষার জন্য কতোটি প্রশ্ন থাকা দরকার, প্রশ্নগুলোর ফন্টের আকার ও পৃষ্ঠাসজ্জা কেমন হওয়া উচিত, নৈর্ব্যক্তিক ও রচনামূলক প্রশ্নসমূহ আদর্শমান অনুসারে তৈরি হয়েছে কিনা, প্রশ্নপত্রে কোনো ভুল বা অসামঞ্জস্যতা আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করে তবেই ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা ভালো। একটি প্রশ্ন আলাদাভাবে বা এককভাবে ভালো কিনা এবং গোটা প্রশ্নপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, সেটিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নৈর্ব্যক্তিক বা রচনামূলক প্রশ্ন কীভাবে তৈরি করতে হয় কিংবা মানসম্মত নৈর্ব্যক্তিক বা রচনামূলক প্রশ্ন তৈরিতে কী কী দিকের প্রতি খেয়াল রাখতে হয়, সেসব বিষয়ে প্রচুর রিসোর্স বিদ্যমান। ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনে নিজস্ব টিম গঠন করতে পারে কিংবা যৌথভাবে, যারা সারা বছর এসব পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করবেন, প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ নেবেন, প্রশ্নপত্র তৈরি করবেন এবং ফলাফল তৈরি করবেন। এটি প্রত্যক্ষভাবে যেমন আদর্শায়িত ভর্তি পরীক্ষা নিশ্চিত করবে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরোক্ষভাবে শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। আর কিছুই করতে না পারলে বা করতে না চাইলে ভর্তি পরীক্ষার বিকল্প বের করা জরুরি। ভর্তি পরীক্ষা যেন বিসিএসের প্রাথমিক সংস্করণ না হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :