প্রবীর বিকাশ সরকার: বাংলার প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে আমাদের জীবনাচারের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক হাজার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ইতিহাস যা সত্যিই একদা বৈচিত্র্যময়তায় ভরপুর ছিলো। বাঙালি মানেই হচ্ছে তার বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি, যা রূপের সে অনুষ্ঠানে জীবন্ত। প্রাকৃতিক আচার-আচরণ কর্তব্য কর্ম তো আছেই, লোকজ ধর্মীয় সংস্কৃতিও ঋতুকে সম্পৃক্ত করে রেখেছে আবহমানকাল ধরে। যদিও অনেক পরিবর্তন-বিবর্তন ঘটে চলেছে বাঙালি সংস্কৃতির, তবে সুরটা এখনো আছে। জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত চলমান যে জীবন তার স্মৃতিও ঋতু দ্বারা আবর্তিত। আমার যে কৈশোর তার সঙ্গে প্রতিটি ঋতু বৃক্ষের বাকলের মতো জড়ানো। সেই বৃক্ষের অজস্র যে পাতা পল্লব ফুল সবই স্মৃতি। তেমনি শরৎকাল এলে পরে মনটা আপনা হতেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। মেঘমেদুর বর্ষার শেষ বর্ষণ যেমন মনকে আচ্ছন্ন করে বিদায়ের বিষণ্নতায় ঠিক তেমনি হঠাৎ এসে উত্তরের বাতাস এলোমেলো করে দিয়ে যায়। এ যেন ক্ষণিকের লুকোচুরি খেলা সূর্যালোক আর সাদা-কালো মেঘের মধ্যে। আসলে শরতের আভাসটা সৃষ্টি হচ্ছে প্রকৃতির মধ্যেই। শরৎ এসে গেল। শরৎ যে এলো কৈশোরে যেমন করে প্রথম টের পেতাম এখন আর তেমনটি নেই। এর নানাবিধ কারণ বিদ্যমান। রাজনৈতিক, সামাজিক, মানসিক, ধর্মীয় এবং পরিবেশগত পটভূমি রয়েছে যা সহজেই দৃশ্যমান। তবে বাংলার ঋতুমালার যে পরিবেশ ও আবহ তার সঙ্গে নগর জীবনের পার্থক্য আগেও ছিলো এখনো আছে। শরৎ ঋতুর ক্ষেত্রেও তাই।
বাঙালি বলতেই শারদীয় উৎসব। যেখানে বাঙালি নেই এই উৎসবটিও নেই। হাজার বছর ধরে বাঙালির জীবনসংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে আছে দুর্গোৎসব। শারদীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক আচার ও বিনোদন তা যে কতোখানি বৈচিত্র্যময় তা তো ব্যাখ্যার অতীত। ধর্মীয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়টি একেবারেই ব্যক্তিগত এক্তিয়ার ভিত্তিক। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও সমালোচনার প্রয়োজন নেই। যেটা আলোচনার বিষয় হতে পারে সেটা শারদীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে আমরা বাঙালি জীবনাচারের স্মৃতিময় আলোচনা করতে পারি। মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করতে পারি। কী হারিয়ে গেলো? কী পেলাম তারও হিসেব-নিকেশ করা যেতে পারে। মনে পড়ে, খুব জ্বলজ্বলে স্মৃতি। এই কুমিল্লা শহরে সম্প্রীতির কোনো সংকট ছিলো না। সম্প্রীতির কী দরদ ছিলো তা শারদীয় উৎসবে কী চমৎকারভাবেই না আমরা উপলব্ধি করেছি। বসন্তের যেমন কোকিলের ডাক তেমনি শরতের ঢাকের শব্দ। সব সম্প্রদায়ের মানুষই অধীর আগ্রহে থাকতো কখন শোনা যাবে শারদীয় ঢাক আর কাঁসারের শব্দ? করতাল আর কীর্তনের সুরেলা আহবান। কখন বাতাসে ভেসে আসবে শিউলি ফুলের মিষ্টি সুবাস? কখন দেখা যাবে পুকুর-দিঘির পাড়ে সাদা কাশফুলের দুলুনি? হাঁসগুলো স্বচ্ছ জলে ডানা ঝাপটাবে সমস্বরে? কখন আকাশে সাদা তুলতুলে মেঘের ওড়াওড়ি শুরু হবে? শরতের আমেজটাই যে অন্যরকম। সারাদিন রোদের উত্তাপে কপালে চিকন ঘামের প্রকাশ আর বিকেল হলে উত্তুরে হাওয়ার হিম হিম ভাব শরতের বৈশিষ্ট্য। কখন দেখা যাবে খড় আর বাঁশের তৈরি কাঠামোর ওপর মাটি লাগিয়ে প্রতিমা গড়ে তোলার কাজটি শুরু করেছে কুমোর এসে। মা আসছেন দোলায় না গজে চড়ে? নাকি নৌকোয়? সন্ধেবেলা চারদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া কেমন একটা ফুলেল আমেজ, বাতাসে কীসের যেন চঞ্চল সৌরভ। স্বচ্ছ নীল আকাশে সাদা মেঘের পথ ভুলে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা। কোজাগরী জ্যোছনা এলে বলে। এসবই শরতের লক্ষণ।
তখন বাজারে গেলে ফলফসারি বিশেষ করে আঁখ ও শসার আগমন জানান দিত শারদীয় উৎসবের আগমনীকে। নজর চলে যেতো ময়দা, বাদাম তেল, বাতাসা, গোবিন্দভোগের চাল, এলাচি আর লবঙ্গের দিকে। হিন্দুদের ঘরে ঘরে পুজোর প্রসাদ হিসেবে বাতাসা, নারকেলের নাড়ু, পেড়া আর কলা একেবারে বাঁধা পদ। কিন্তু শারদীয় পুজোর সময়কার প্রসাদে যেন আলাদা একটা স্বাদ ছিলো। ভোরবেলা ঠাণ্ডা জলে ডুব সাঁতার কেটে খালি পেটে হাজির হতাম অঞ্জলি নেওয়ার জন্য। পাশের যে মেয়েটি আমারই মতো কৈশোর পেরোয় পেরোয় কী ভারিক্কিই না লাগতো নতুন লালপেড়ে ঘি-রঙা গরদের শাড়িতে তাকে। প্রতিদিন যাকে সকাল-বিকেল দেখি অথচ সেদিন দুর্গাপুজোর অষ্টমীরদিন সকালে তাকে দেখে একেবারে নতুন মনে হতো। পুরনোকে নতুন করে দেখার রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগত এই দুর্গাপুজোর সময়ই। এটা তো ঐতিহ্য, জানি না কবে থেকে তার শুরু: চারদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাজত মাইকে বাংলা আর হিন্দি গান। কী দারুণ দারুণ মন মাতাল করা সব গান। পুজো উপলক্ষ্যে নতুন বাংলা গানের রেকর্ড বের হতো কলকাতা থেকে তার প্রতীক্ষায় থাকতাম সারাবছর। বন্ধুদের মধ্যে তর্কাতর্কি তা কার গান হিট লিস্টে প্রথম হবে। বাজিও ধরেছি আমরা। নতুন জামা তৈরির জন্য বন্ধুরা একসঙ্গে দোকানের পর দোকান ঘুরে বেড়াতাম। চেক কাপড়ের বেশ সমাদর ছিলো, একসঙ্গে একই ডিজাইনের জামা তৈরির জন্য রাণীর বাজারের ‘আল্পনা টেইলার্সে’ ভিড় জমাতাম। সময়টা তখন ১৯৭৩-৭৪ সাল হবে। শারদীয় উৎসব নতুন আমেজ, নতুন অনুভূতি এবং নতুন অঙ্গীকারের বাসনা নিয়ে আসত।
পাড়ায় পাড়ায় পুজো হতো, অনেক পুজো। সব সম্প্রদায়ের বন্ধুরা একত্রিত হতাম। শুভেচ্ছা বিনিময় হতো। প্রসাদ খেতাম ভক্তিভরে। সে সুর আর সম্প্রীতি কেটে গেলো ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে রাতের অন্ধকারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। সেই অপহৃত সুর আর সম্প্রীতি ফিরে আসেনি এই বাংলায়। ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, মৌলবাদের উত্থান, হত্যা-ঘুম, জমিদখল, মন্দিরভাঙা একটা অপয়া সংস্কৃতিতে দাঁড়িয়ে গেছে এতোদিনে। দেশ ত্যাগের হিড়িক আমাদেরকে মিইয়ে দিয়েছে একেবারে তলানীর দিকে। একটি সম্প্রদায়ের মিলিয়ে যাওয়া মানেই এই বাংলায় শরতের মাঙ্গলিক সংস্কৃতিটা হয়তো বা চিরতরে হারিয়েই যাবে। সত্যি এবং চরম বাস্তবতা এখন এই যে, শারদীয় উৎসব আগের মতো যেমন নেই, শরৎকালও পরিবর্তিত পরিবেশ নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে, বৈচিত্র্যময় শরৎ আর আগের মতো নেই। সমগ্র জাতির মধ্যেই সুর আছে তাল নেই, সম্প্রীতি আছে পারস্পরিক ভক্তি ও বিশ্বাস নেই। করোনা মহামারি এসে আরও বিষণ্ন করে দিলো শারদীয় আয়োজনকে। শ্রী শ্রী দুর্গাদেবী যদি এবার অতিমারিকে দূর করে পৃথিবীকে শঙ্কামুক্ত, সুস্থ এবং আলোকিত করে দেন তাহলেই বাঁচি। লেখক: রবীন্দ্রগবেষক