খান আসাদ: ‘হিংসার রাজনীতি’ বললে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কিছুই বোঝা যায় না। ২১ আগস্ট কারা কেন ঘটিয়েছে, এর অভিঘাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কী প্রভাব পড়েছে এবং এই ঘটনায় কারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে- সেই বিশ্লেষণ এখনো শেষ হয়েছে বলে মনে হয় না। ২১ আগস্টের হামলার রাজনৈতিক পটভূমি বাংলাদেশে ‘সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদী’ রাজনীতির দ্বন্দ্ব এমন মাত্রায় বিকাশ ঘটেছিলো যে তা তাদের প্রতিপক্ষ ‘সেক্যুলার’ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান দলটিকে পুরো নেতৃত্বশুন্য করে ফেলতে চেয়েছিলো। চিন্তাটা ছিলো ফ্যাসিবাদী ‘ফাইনাল সল্যুশনের’।
রাজনৈতিক সরকারের উপাঙ্গ একটি অংশ, মূলত তারা ইসলামী জঙ্গিদের সহায়তায় এই ‘ফাইনাল সল্যুশন’ ধরনের ফ্যাসিবাদী হামলাটি চালায়। এখানে কে নেতৃত্ব দিয়েছে, ইসলামী জঙ্গিবাদ না রাজনৈতিক দলটির ফ্যাসিস্ট অংশটি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ তাদের মতাদর্শগত অবস্থান, সহিংস পন্থায় ‘ফাইনাল সল্যুশনের’ ফ্যাসিবাদী রাজনীতি। সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র রক্ষণশীল হতে পারে, রক্ষণশীল উদারনৈতিক মিশ্রণ হতে পারে, কিন্তু তারা ফ্যাসিস্ট নয়। ফলে, একদিকে মতাদর্শগতভাবে অন্যদিকে আইনি সহিংসতার বৈধ অধিকারী হিসেবে তারা যেকোনো জঙ্গি সহিংসতার বিপক্ষে অবস্থান নেবেই। জঙ্গিদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলটি সামরিক বেসামরিক আমলাতত্রের আস্থা পুরোটাই হারায়। যার, প্রভাব আমরা দেখি নির্বাচনে আমলাতন্ত্রের ভূমিকায়। জিহাদ হচ্ছে শ্রেণীসংগ্রাম ধারণায় বিশ্বাসী, ব্যাঙ্গ করে যাদের ‘বামাতি’ বলা হয়, তারা আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে প্রচার করে। আসলে তারা নিজেরাই ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ধারণ করে এবং রাজনীতিতে সহিংস ‘ফাইনাল সল্যুশন’ চায়।
কিছুদিন আগে ‘সঠিক নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ হারবে ও জনগণ তাদের ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলবে’ (স্মৃতি থেকে বলছি) এরকম একটি বক্তব্য দেখেছিলাম। সম্প্রতি একজন ‘বুদ্ধিজীবী’ একই ধরনের কথা বলছেন, আফগানিস্তানের ঘটনা উল্লেখ করে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ‘বাক স্বাধীনতা হরণের’ ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যারা ‘বাক স্বাধীনতা’ নিয়ে চিন্তিত, তাঁদের এই চিন্তা করা খুবই দরকার, যে আসলে ওই ‘বাক’ যে বার্তা দেয়, তা রাজনৈতিক সহিংসতাকে নরমালাইজ করা, বৈধতা দেয়া, উস্কে দেয়া ও প্ররোচনা দেয়া হয় কি না। এই ‘বাক’ বা বক্তব্য মতাদর্শের দিক থেকে ফ্যাসিবাদী কিনা। গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি, ন্যায়, সাম্য ও শান্তি চাইলে সবাইকেই বৈষম্য ও সহিংসতার বিরোধিতা করতে হবে। মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানের পথে এগুতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক ও সমালোচনার মধ্য দিয়েই এগুতে হবে, সহিংস ‘ফাইনাল সল্যুশন’ উস্কে দিয়ে নয়।
২১ আগস্ট থেকে যে শিক্ষা সবারই নেয়া উচিত, তা হচ্ছে, চূড়ান্ত বিচারে, সহিংস পন্থায় কোনো ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করা যায় না। (আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র গণপ্রতিরোধ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ‘সহিংস পন্থা’ দয়া করে গুলিয়ে ফেলবেন না।) সহিংসতা মানে কেবল শারীরিক প্রত্যক্ষ সহিংসতা নয়। কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক সহিংসতাও রয়েছে। কাঠামোগত সহিংসতা নিয়েও ভাবুন। ধর্মের নামে, উন্নয়নের নামে, গণতন্ত্রের নামে, পুঁজিবাদের নামে সকল ধরনের প্রত্যক্ষ ও কাঠামোগত সহিংসতা রূপান্তর করেই সমাজ ও সভ্যতা এগুবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা। ফেসবুক থেকে