চিররঞ্জন সরকার: আমি তখন সংবাদে কাজ করি। কার্টুনিস্ট কুদ্দুস অনেকক্ষণ ধরেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশ দেখতে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলো। হাতের কাজ শেষ করতে করতে সাড়ে পাঁচটা বেজে যায়। ততোক্ষণে কুদ্দুস সমাবেশ দেখতে চলে গেছে। কথা ছিলো কাজ শেষ করে আমি ওখানে গিয়ে কুদ্দুসকে ফোন দেবো। সাড়ে পাঁচটার পর আমি বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশ দিয়ে এগোতে থাকি বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দিকে। জিপিওর সামনে যেতেই কয়েকটা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের আওয়াজ কানে এলো। গুলিস্তান সিনেমা হলের দিকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখতে পেলাম। মুহূর্তেই দেখি সমাবেশে আসা মানুষজন দ্বিগি¦দিক ছুটছে। আমি জিপিওর কোণায় স্টেডিয়াম ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যাই। জিরোপয়েন্ট এলাকায় একটা দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ভ্যানকে দ্রুত চলে যেতে দেখি। শুনতে পাই আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। একজন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়াতে দৌড়াঁতে বলেন, যে শত শত মানুষ মারা গেছে! আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে একা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি! খানিক বাদেই দেখি রক্তাক্ত শরীর নিয়ে অনেককে রিকশা ও ভ্যানে করে জিপিওর সামনে দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে নেওয়া হচ্ছে। কাউকে কাউকে কোলে কাঁধে ধরাধরি করে আনা হচ্ছে। রিকশা-ভ্যান-গাড়ি কিছুই নেই। অসহায় সহকর্মীরা চিৎকার করছে। কাঁদছে। ভয়ে-আতঙ্কে-রাগে-ক্ষোভে-অসহায়তায় পুরো এলাকার পরিস্থিতি ভয়াল হয়ে ওঠে। ওখানে দাঁড়িয়ে গ্রেনেডে ঝলসানো ছিন্নভিন্ন রক্তমাখা কয়েকটা শরীর দেখে আমিও প্রায় নিঃসাড় হয়ে যাই। এরপর আমি কী করেছিলাম, কীভাবে বাসায় ফিরেছিলাম কিছুই মনে নেই। তবে বাসায় ফিরতে রাত হয়েছিলো- এটুকু শুধু মনে আছে। একুশে আগস্ট আমার জীবনেও একটি দুঃসহ ভয়ঙ্কর স্মৃতি! সেদিনের সন্ধ্যায় মানুষের আর্তনাদ, ছোটাছুটি, ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বাঁচার এবং বাঁচানোর আকুতির দৃশ্যগুলো মনে পড়লে আজও শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ঘটনাটা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের জ্ঞাতসারেই হয়েছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরও কিন্তু এই হামলার দায় আওয়ামী লীগের ওপরই চাপানো হয়েছিলো। অনেকে তা বিশ্বাসও করেছিলো। ১৯৭৫ সালে যেভাবে আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো, ঠিক একই রকম ছক ছিলো ২১ আগস্টেও। দৈবক্রমে গ্রেনেডটি মঞ্চে ফাটেনি। এরপর ২১ আগস্টের ঘটনাটিকে আড়াল করা, আওয়ামী লীগের ওপর দায় চাপানো, জজমিয়া নাটক সাজানো- সব কিছুই বিএনপি করেছে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়, বেগম জিয়ার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়-বিকাশের সুযোগ দেওয়া, পুনর্বাসন, তাদের যেন বিচার না হয়- সেজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা- এসবই বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি করেছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়েছে। তারপরও এদেশের এক শ্রেণির মানুষ বিএনপিকে সমর্থন করে।
বর্তমান সরকার বিএনপির বিরুদ্ধে অনেক নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। কিন্তু তাদের গ্রেনেড মেরে শেষ করে দিতে চায়নি। হত্যা-খুনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কখনও প্রতিপক্ষকে ১৫ আগস্ট কিংবা ২১ আগস্টের মতো শেষ করে দেওয়ার রাজনীতি করেনি- এটাই আওয়ামী লীগের সব চেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য বলে আমার কাছে মনে হয়। কিন্তু তারপরও বিএনপির প্রতি এ দেশের মানুষের এতো সমর্থন ও সহানুভূতি কেন? আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের এতো ক্ষোভ-বিদ্বেষই বা কেন? এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগেরও আত্মসমীক্ষা ও আত্মসমালোচনা করা দরকার। ফেসবুক থেকে