অজয় দাশগুপ্ত: মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এই মানুষটি বলতে গেলে একাই লড়াই করেছিলেন। এর আগের একটা ঘটনা বলি। একাত্তরের শুরুতে পাকিস্তানিরা গোলটেবিল বৈঠক ও আলোচনার নামে সময় নষ্ট করছিলো। ভেতরে ভেতরে বাঙালি নিধনের ব্লু-প্রিন্ট তখন রেডি। ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকে থাকতেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ঝানু বদমেজাজি ও জমিদার পুত্র। ভুট্টো বলেছিলেন, দৃঢ়চেতা, সাহসী শেখ মুজিবকে তাও কিছু বোঝানো যায়, কিন্তু সাদা হাফ হাতা শার্টের লোকটা নাছোড়বান্দা। এ কেন থাকে সঙ্গে? Very difficult to convince him. স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোসহীন ও নির্ভীক। একাত্তরে ভারতেও মতভেদ ছিলো। একদল চাইতো না তারা এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুক। বাজপেয়িরা চাইতেন সিকিমের মতো দখল নিক। অক্টোবর মাসে ইন্দিরা গান্ধী ইউরোপ ও আমেরিকা ট্যুরে যাবার সময় ইংগিত দিলেন, এবার এসপার বা ওসপার। দরকার হলে সামরিক অ্যাকশানে যাবেন তারা। ব্যস। অতি উৎসাহী আওয়ামী লীগ নেমে পড়লো প্রচারে। খন্দকার মোশতাক গংও চুপ থাকলো না। তারা চাইলো বিদেশ গিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশানের ঘোষণা দিতে। সে সময় কঠিন হাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একা সামাল দিয়েছিলেন
তিনি। এবং ইন্দিরা গান্ধী জানিয়ে দিয়েছিলেন কেবল এই একটি মাত্র মানুষকেই তারা জানাবেন, কী হচ্ছে, কী হতে পারে।
কলকাতায় যখন নেতারা বিলাসও বিনোদনে ব্যস্ত তিনি তখন তার অফিসের মেঝেতে ঘুমাতেন। একটি রাতও স্ত্রী পরিবারের সঙ্গে কাটাননি। সোহেল তাজ তখন শিশু। তার অসুস্থতার সময় আগে ছুটেছেন ক্যাম্পে। অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের দেখভাল করতে। বিনিময়ে তখনকার যুব নেতা একরাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এসেছিলো তাকে হত্যা করবে বলে। তিনি মৃত্যুকে পরোয়া করতেন না। তাই দল যখন তাকে একা করে দিয়েছিলো, বঙ্গবন্ধু অনেক দূরে, তখনও তিনি আদর্শ আর আনুগত্যের জন্য জান দিতে দেরী করেননি। বরং জেলখানায় সহবন্দী কামরুজ্জামান সাহেব যখন গোলাগুলির শব্দে ভীত হতবিহ্বল তখন শান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, যান অজু করে নামাজটা পড়ে আসেন। মৃত্যুর জন্য এমন শান্ত অপেক্ষা বিরল। বায়াত্তরের ১১ জানুয়ারি তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সংগ্রাম হচ্ছে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার লড়াই। তাই পার্লামেন্টারি শাসনই ভালো এবং তিনি সরে যাচ্ছেন তার পদ থেকে।
বঙ্গবন্ধুকে জানাতে চেয়েছিলেন নয় মাসের অভিজ্ঞতা ও শত্রু মিত্রের আসল চেহারা। কিন্তু বাইরে অগণন দর্শণার্থী আর নেতাদের ভিড়ে একসময় হারিয়ে গেলেন তিনি। সে কথা আর কোনদিন বলার সুযোগ পাননি। বলতে পারলে ও বঙ্গবন্ধু জানতে পারলে হয়তো দেশ ও সমাজের চেহারা হতো একেবারে অন্য ধরনের। কিন্তু মোশতাকেরা তা হতে দেয়নি। আজও দেয় না। তবু একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ ও তিনি এক এবং অভিন্ন। ইতিহাসে মহাভারতের এই অর্জুনের নাম তাজউদ্দীন আহমদ। ২৩ জুলাই ছিলো মহান এই মানুষটির জন্মদিন। তার প্রতি শ্রদ্ধা।
লেখক : কলামিস্ট, অস্ট্রেলিয়া, মেলবোর্ন