কালের কণ্ঠ: দেশে সারের চাহিদা পূরণে তিন বছর ধরে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সার আনতে হয়। অথচ এর অর্ধেক টাকা খরচ করে ওই পরিমাণ সার দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব। এমনকি দেশে যে আটটি কারখানা আছে সেগুলো আধুনিকীকরণ করা হলে সারা বছরই উৎপাদন সম্ভব হতো। তাহলে বছরে ৪০ লাখ টন সার উৎপাদন করা যেত। দেশের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সার বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হতো।
সার কারখানা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
দুই দশক আগেও স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশ থেকে সার রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু সার কারখানাগুলোর বয়স বাড়তে থাকায় যান্ত্রিক ত্রুটিও বাড়তে থাকে। যান্ত্রিক ত্রুটি এবং গ্যাস স্বল্পতার কারণে বেশির ভাগ সার কারখানা বছরে চার থেকে সাত মাস বন্ধ থাকে। সে কারণে দেশের সার কারখানাগুলোতে সার উৎপাদন কমছে। তাই সারের চাহিদা পূরণে আমদানির পরিমাণ বাড়াতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সার কারখানাগুলো আধুনিকীকরণ এবং নতুন সার কারখানা স্থাপন করা সম্ভব হলে সার আমদানির প্রয়োজন হবে না।
সার কারখানা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, সার আমদানি কমাতে দেশের কারখানাগুলো আধুনিকীকরণ এবং নতুন কারখানা নির্মাণ করা হবে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে একসময় আটটি সার কারখানায় সার উৎপাদন হতো। এর মধ্যে পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড (পিইউএফএফএল) ও ঘোড়াশালে অবস্থিত ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড (ইউএফএফএল) আধুনিকীকরণের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ রয়েছে।
দেশে যে আটটি সার কারখানা রয়েছে তার ছয়টি ইউরিয়া কারখানা। বাকি দুটি টিএসপি ও ডিএপি কমপ্লেক্স।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) দেশে ২৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন সারের চাহিদা ছিল। এর মধ্যে ১০ লাখ ২০ হাজার টন দেশের কারখানায় উৎপাদন হয়েছে। বাকি ১৫ লাখ ৩০ হাজার আমদানির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে (২০২১-২২) চাহিদার ২৬ লাখ টনের মধ্যে ৯ লাখ টন দেশের সার কারখানাগুলো থেকে এবং বাকি ১৭ লাখ টন আমদানি করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমদানি হওয়া সারের বেশির ভাগই ইউরিয়া।
সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সার কেনা হয়। সম্প্রতি এই কমিটি ৪৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বেলারুশ থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টন এবং ৭২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে তিউনিশিয়া থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টন সার আমদানির অনুমতি দিয়েছে। বেলারুশ থেকে কিনতে প্রতি টনের দাম পড়েছে ২৪ হাজার ৮৮৮ টাকা এবং তিউনিশিয়া থেকে কিনতে ৪৮ হাজার ২৬৬ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম ওঠানামা করে। গড়ে প্রতি টন সারের দাম ৩০ হাজার টাকা করে কেনা হলে চলতি এবং আগামী অর্থবছরে কিনতে ব্যয় হবে গড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, সার কারখানাগুলোর অর্ধেক যান্ত্রপাতিও যদি আধুনিকীকরণ করা হয় তবে আমদানির অর্ধেক ব্যয় হবে উৎপাদনে। যমুনা ফার্টিলাইজার কম্পানি লিমিটেডের (জেএফসিএল) কারখানা এক দিন বন্ধ থাকলে ১৭০০ টন সার উৎপাদন কম হয়। এই পরিমাণ সার উৎপাদনে জ্বালানি ও কাঁচামালের খরচ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ সব ধরনের খরচ মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মোট ব্যয় হয় দুই কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে ১৭০০ টন সার আমদানিতে উৎপাদনের খরচের চেয়ে দ্বিগুণ ব্যয় হয় প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কম্পানি লিমিটেড (এএফসিসিএল) এক দিন বন্ধ থাকলে ১৬০০ টন সার কম উৎপাদন হয়, যা আমদানিতে ব্যয় হয় পাঁচ কোটি টাকা। এই পরিমাণ সার দেশে উৎপাদনে দুই কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়। উৎপাদনের পরিবর্তে আমদানিতে প্রতিবছর সরকারের নিট লোকসান প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। আবার সার কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় করপোরেশন হয়েও বিসিআইসি ক্রমাগত লোকসানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সার কারখানাগুলোতে দীর্ঘদিন যন্ত্রপাতির সুষ্ঠু মেরামত ও আধুনিকায়ন না হওয়ায় উৎপাদন খরচ ও ব্যয় বেড়ে যায়। পরিবেশ দূষণ হয়। উৎপাদনও কমতে থাকে। যন্ত্রপাতি মেরামত ও নতুন সংযোজনের পর আটটি সার কারখানা সারা বছর সচল থাকলে বর্তমানে ৪০ লাখ টনের বেশি সার উৎপাদন সম্ভব বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
বিসিআইসির পরিচালক (উৎপাদন ও গবেষণা) শাহীন কামাল বলেন, ‘সার আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পুরনো কারখানাগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকীকরণ এবং উত্তরাঞ্চলে আরো একটি নতুন সার কারখানা নির্মাণে বিসিআইসি কাজ করে যাচ্ছে। পলাশ ও ঘোড়াশালের কারখানা দুটি আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাজ শেষ হলে কারখানা দুইটিতে উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
সার কারখানাগুলো উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল গ্যাসের সংকটে বছরের চার থেকে সাত মাস বন্ধ থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষকদের দিয়ে এক গবেষণা করান। ওই গবেষণায় সার উৎপাদনে গ্যাসের পরিবর্তে কয়লা ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়। শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির কর্মকর্তারা এ বিষয়ে দুই-চারটি বৈঠক করলেও এ উদ্যোগ ফাইলবন্দি হয়ে আছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘সার কারখানাগুলো এই দেশের সম্পদ। কারখানাগুলো সুষ্ঠু ব্যবস্থপনায় চালাতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে সার রপ্তানি সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশেই কয়লা ব্যবহার করে সার উৎপাদন হচ্ছে।’