মুনমুন শারমিন শামস: বহুত দিন পর পুরা সমাজের মুখে এমন এক চারশ শিক্কার থাপ্পড় পড়সে, হা হা হা... ভাবতেই মনটা চনমন কইরা ওঠতেসে। মানে আপনারা তো ধরেই নিসেন যে এই সমাজের প্রতিটা মেয়েই এক একটা মাল আর কি। প্রত্যেক মেয়েরেই আপনারা ধর্ষণ করার ইচ্ছা রাখেন এবং যখন খুশি সেই ইচ্ছা প্রকাশ্যে প্রকাশ করেন আর সুযোগ পেলে ধর্ষণ করে দেন। মানা করার কেউ নাই। নিষেধাজ্ঞার ব্যাপার নাই। আইন টাইন আছে, কিন্তু সেসব অত পরোয়া করার কোনো দরকারই হয় না। আইন চলে পুরুষের ইচ্ছায়। পুরা সিস্টেমই তো তাদের। তাই আইন দরকারে অদরকারে বেকে টেকে কেটে পড়ে। তো সমাজের এই এই মালেদের, মানে নারীদের তো আপনার মোটামুটি ভাগজোগ করে নিসেন। এখন ধরেন সমাজে কালো পয়সার একটা বড়সড় উত্থান ঘটছে। প্রচুর মাফিয়া টাফিয়া গজাইসে। দেশ চালাচ্ছেন এমন সব বড় বড় হর্তাকর্তার সঙ্গে মিলেজুলে চলতেসে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা বাণিজ্য, চোরাপথে আনাগোনা। পুঁজিবাদের ঘন অন্ধকারে পুষ্টি পেয়ে মোটাতাজা হওয়া পিতৃতন্ত্র পুরো ব্যবস্থাতেই পুরুষকে রেখে দিয়েছে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। পুরুষের ক্ষমতা আরও বাড়ছে। তাই তাদের এখন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থা আর কি। কোনটা খাবে, কোনটা ফেলবে, কোনটা ছড়াবে, মাথা গেসে আউট হয়ে। এতো টাকা, এতো ক্লেদ আর এতো লোভ- সব মিলেঝুলে দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য কালো টাকার স্রোতে ভাসা পুরুষের দল এখন ভোগের নানা উপাদান যোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত।
ধরেন ভোগ মানেই তো খাওয়া, নেশা করা আর অবাধে যৌনতা। যাদের সৎ টাকা, মানে যারা সৎ পথে আয় করেন, তাদের তো শিক্ষাদীক্ষা আছে, রুচি আছে, চিন্তার গভীরতা আর দেশপ্রেম আছে। ফলে তারা যখন যতোটুকু টাকার মালিক হয় তখন সেটা ব্যয় করেন সৎ আর সুন্দর কাজে। পরিবারেই হোক, ব্যক্তিগত জীবনেই হোক কিংবা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কাজে হোক। টাকা তাদের ব্যয় করেন ভালো কোনো কর্মে। আর ধরেন যে তৃতীয় শ্রেণির অশিক্ষিত অসভ্যগুলো কালো টাকা, ক্ষমতা আর লোভের জগতে বিচরণ করে, তাদের টাকা ব্যয়ের রাস্তাও এইগুলাই-খাওয়া, অনেক অনেক খাওয়া, গাদা গাদা খাওয়া, আর শোয়া, শুতেই থাকা, নানা বিকৃতির ভেতর দিয়ে শোয়া এবং অবশ্যই নানামুখী নেশায় বুদ হয়ে থাকা। তো নারী তো একটা পণ্যই এই সিস্টেমে। পুঁজিবাদের মূল ঝোঁক সমস্ত কিছুকে পণ্য বানায়ে ফেলা। নারীকেও। বানাইছেও তাই। এখন ধরেন, সমস্যাটা ঘটে গেছে এখানেই। পুঁজিবাদ তো আছেই। পিতৃতন্ত্রও আছে। এদিকে নারীও এর ভেতরেই কেমনে জানি জাল কাটতে শুরু করসে। এখন ওই যে পিতৃতন্ত্রের মগজে ঢুকে গেসিলো, নারীকে ইচ্ছামতো কিনে নেয়া যায়, সাত চড়ে রা করবে না, শুতে বললেই শুবে। একটুখানি ঘাড় তুল্লেই বেশ্যা বলে ডাক দিলেই জোঁকের মুখে নুন দেবার মতো পোতায়ে যাবে! তাই পুরা বিষয়টাই খুব সহজ ছিলো। পরীমণিকে আপনারা দেদারসে যা ইচ্ছা বলতে পারেন, হাহা হিহি করতে পারেন, আবার কেউ কেউ ‘বেশ্যা হলেও তাকে ধর্ষণ করা যায় না’ লিখে সহানুভূতি করতে পারেন। কেন পারেন? পরীমণি যে বেশ্যা সেটা কীভাবে জানেন? কারা বললো? সেই মাফিয়ারা? সেই ক্ষমতাবানরা? সেই তারাই যারা পরীমনিকে সিনেমায় ব্রেক দেয়, পরিচিতি দেয়, আবার ধর্ষণের জন্যও ফাঁদ পেতে রাখে, তারাই তো? আবার ওদের রাজনৈতিক চ্যালা ম্যালা, সহমত ভাইয়া, রিপোর্টার সোনাচান্দরা এখন সিসিটিভি খুঁজে ঘেটে বের করতেসে পরীমনি কবে কবে কোন ক্লাবে কী কী ভাঙচুর করসে।
মানে দেখেন, পুরা সিস্টেমটাই এমন কইরা বানানো। তারা গ্রাম থেকে মুনিয়া কিংবা স্মৃতিকে নিয়ে আসবে শহরে। এরপর তারাই তাদের পরিচিতি দেবে। তার বদলে তাদের প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে মেয়েগুলোকে। এইটাই সিস্টেম। আর যদি না মানো তাইলে তোমার লাশ ঝুলবে গুলশানের ফ্ল্যাটে। আর নয়তো তোমারে শায়েস্তা করতে সহমত ভাই থেকে শুরু করে চ্যানেলের সাংবাদিক হয়ে ফেসবুকের আবুল কুদ্দুসরা তো আছেই, আইনের মারপ্যাঁচ আর অন্যসব ক্ষমতার দড়ি লাঠিও আছে। আর মনে রাখবা প্রতিটা শায়েস্তাকরণ প্রক্রিয়ার ভেতরেই আছে তোমার বেশ্যাত্ব, তোমার কয়ডা বিয়া হইছিলো তার বেত্তান্ত, তোমার চেহারা, তোমার পোশাক, তোমার পরিবার ও তোমার স্তনের মাপ। এখন সমস্যা হৈল, মুনিয়া তো মরে গেলো। কিন্তু পরীমণি রেগে গেলো। পরীমণি ঠাস কইরা একটা চড় কষায়ে দিল পুরা সিস্টেমের মুখে। নারীরে কিনে নেওয়ার যে অসভ্য সিস্টেম তৈরি কইরা রাখছে পুঁজিবাদের পুঁজচাটা মাফিয়া কালোবাজারিরা, আজকে সেই সিস্টেমকে চটাস কইরা একটা চড় কষায়ে পরীমণি বুঝায়ে দিলেন, আল্টিমেটলি নারীর শরীর কিনে নেয়ার এই অসভ্য বাজার ব্যবস্থারে ভাঙতে হবে। হ, উনিও এই সিস্টেমের ভেতরে থেকেই নায়িকা হইসেন বটে, সে তো আমি আপনি সবাই ওই সিস্টেমেই আছি। নাই? কিন্তু তার মানে এই দাঁড়ায় না যে, সিস্টেম আপনারে ধর্ষণ কিংবা হত্যা করতে পারে।
এই ‘করতে পারে না’র জায়গাটাই ক্লিয়ার করতে বিশেষ ভূমিকা রাখলেন পরীমনি। তিনি যদি চুপ থাকতেন, তিনি যদি চিৎকারটা না করতেন, তাইলে আমাদের অসভ্য মন এই ধারণা নিয়াই আরো কয়েক বৎসর কাটায়ে দিতো যে- সিনেমার নায়িকা হইলেই, রাতে বাইরে বের হইলেই, ক্লাবে মদ খাইলেই, ছেলে বন্ধু নিয়া ঘুরলেই, একাধিক বিবাহ করলেই, লিভ টুগেদারে থাকলেই, পুঁজিবাদের ট্যাকায় সিনেমা নাটক বিজ্ঞাপন করলেই সেই নারীর উপ্রে মাফিয়া জগতের ক্ষমতাধর, পয়সাধর, ধ্বজভঙ্গ পুরুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়া যায়; তার উপ্রে ফেসবুকের কুদ্দুস মুদ্দুস আবুল ছাবুলের অধিকার প্রাপ্তি হয়, চ্যানেলে চ্যানেলে রিপোর্টের নামে তার জীবন নিয়া অসভ্য বেত্তান্ত প্রচারের নিয়ম জারি হইতে পারে। হা, চড় খাইয়াও স্টিল এইসব হইতেসে, কিন্তু একই সঙ্গে এইগুলা যে নিয়ম না, এইগুলা যে আইন না, এইগুলা যে অধিকার না, নৈতিক না, সঠিক না বরং এইগুলা যে আসলে অসভ্যতা, বর্বরতা, চূড়ান্ত নোংরামি ও ঘৃণাকর ক্লেদাক্ত, সেইটা নিয়াও কথা হইতেসে। অ্যাটলিস্ট কথা বলা শুরু হইসে। পরীমনি আমাদের সেই কথা বলার শুরুটা করে দিসেন সিস্টেমের মুখে চটাস কইরা প্রচণ্ড চড়টা কষায়ে দিয়া। ধন্যবাদ পরীমনি। মদ খাওয়া নাসিরদের সমালোচনা রাইখা ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র ঘাটার সমাজরে তিনবেলা থাপড়ানোর এই সাহসটা সকল মেয়ের হোক। থাপ্পড়টাই আসল। আর সব বিফল। ফেসবুক থেকে