দিলওয়ার খান: সাংবাদিকতা পেশা এমনিতেই চ্যালেঞ্জের, তার ওপর আবার মফস্বল সাংবাদিকতা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় সাংবাদিকদের। নানান হুমকি, মামলা-হামলার শিকার হতে হয় যে পেশায়, সেটা মফস্বল সাংবাদিকতা। একটা সংবাদ তৈরি করতে হলে ছুটতে হয় একেবারে তৃণমূলে। অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। দুর্নীতি, অনিয়মের সংবাদ তৈরি করতে হুমকি বা হামলা হয়। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন বা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সংবাদ হলেই অবস্থা কিছুটা অন্যরকম! মফস্বল এলাকায় সাংবাদিকদের তেমন নিরাপত্তা দেওয়ারও কেউ থাকে না।
আজ আমি নেত্রকোনা সাংবাদিকদের কথায় বলছি। প্রায় তিন দশকের বেশি সাংবাদিকতার অভিজ্ঞাতার আলোকে আজ লিখছি মফস্বল সাংবাদিকতার ইতিকতা। দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে, সত্যেরে পক্ষে কলম ধরতে গেলেই চলে আমাদের ওপর অত্যাচারের স্ট্রিমরোলার। কখনো প্রত্যক্ষ, কখনোবা পরোক্ষভাবে শিকার হতে হয় তাদের রক্তচক্ষুর চাহনির। কখনো মিথ্যা মামলা, কখনো শারীরিক নির্যাতন, কখনোবা হুমকি-ধামকির মাধ্যমে স্তব্ধ করে দিতে চায় আমাদের ক্ষুরদার কলমের পথচলা। কেবল যে ঢালাওভাবে তাদেরই দায়ী করবো, তা নয়। তাদের সঙ্গে আমাদের একশ্রেণির স্বার্থবাজ সাংবাদিকদেরও কখনো ইন্ধন থাকে।
নেত্রকোনা আনসার অফিসের তিনদশক পূর্বে বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতি বিষয়ে লিখতে গিয়ে একটি মিথ্যা মামলা দিয়ে কলম সৈনিককে স্তব্ধ করে দেওয়ার এক ঘৃণ্য অপচেষ্ট হয়েছিলো। ১৯৯১ সালের ১ নভেম্বর ‘নেত্রকোনা আনসার অফিসে ভুয়া লোক দেখিয়ে লাখ লাখ টাকার রেশন সামগ্রী আত্মসাৎ’ শিরোনামে একটি সংবাদ পরিবেশন করেছিলো দৈনিক আল আমিন পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা তরিকুল ইসলাম রাজা মিয়া। এ দুর্নীতিকে পাশ কাটাতে সংশ্লিষ্ট অফিস পরিকল্পিতভাবে অফিস সহকারী টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলার কালিয়ান গ্রামের হেলাল উদ্দিন নামের একজনকে বাদী করে একটি মামলা করে। অভিযোগ ছিলো, এই হেলালের ছেলে শামীম আল মামুন ওরফে রোকনকে অপহরণ করা হয়েছে মর্মে তাদের অফিসের ৪ জন আনসারকে আসামি করে একটি মামলা করে।
এই মামলার খবর প্রকাশের দায়ে সাংকাদিক তরিকুল ইসলাম রজাসহ অপরাপর ৮ জনকে ১৬৪ ধারায় অপহরণসহ হত্যা মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়। ইতোমধ্যে সিআইডি পুলিশ সাংবাদিক রাজাসহ ৮ জনের নামে অভিযোগপত্র দায়ের করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানার জনগন ১৪ মাস পর হেলালের অপহৃত ছেলে শামীম আল মামুন ওরফে রোকনকে জীবিত উদ্ধার করে পুলিশে সোপর্দ করে। অত্র মামলায় সাংবাদিক রাজাকে শারীরিক ও আর্থিকভাবে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ১৩৩ দিন কারাগার বরণের পর ১৯৯২ সালে হাইকোর্ট থেকে ছাড়া পান।
সম্প্রতি কথিত অপহৃত রোকন ও তার পিতা বাদী হেলাল উদ্দিন পর্যায়ক্রমে ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত জেলা দায়রাজজ আদালতে তরিকুল ইসলাম রাজা মিয়াকে দেখেনি ও চিনেনি বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করে এবং সাক্ষীকালে বিজ্ঞ আদালতকে জানায়, রাজার বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। হাইকোর্ট ডিভিশন মামলার ১৮ বছর পর হত্যা মামলা হতে অব্যাহতি পান সাংবাদিক রাজা মিয়া। যদি ভিকটিম শামীম উদ্ধার না হতেন, তবে ইতোমধ্যে সাংবদিক রাজা মিয়ার ফাঁসি হয়তো কার্যকর হয়ে যেতো! মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ভুলভাবে একজনের পেছনে দৌড়ে মূল হত্যাকারীকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখায় এখন নিহত ব্যক্তির বিচার কি আদৌ হবে? হলে কে হবে আসামি? তা তদন্ত সাপেক্ষে আইননুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য আইন পাস করা উচিত এবং আইনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আইনের পাশাপাশি সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একত্রে থাকলে শক্তি পাওয়া যায় এবং প্রতিপক্ষ ভীতচিত্ত অবস্থায় থাকে। দেশে দিন দিন সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতন বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংবাদিকের ওপর হামলা হচ্ছে। বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। কিন্তু এর কোনো বিচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় সাংবাদিকরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। সরকারের উচিত সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ নজর দেওয়া এবং সাংবাদিক নেতাদের উচিত সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি উপস্থাপন করা। মফস্বল সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন। আর এমনিতেই তো মফস্বল সাংবাদিকতা একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। এটা দেশের সব শ্রেণির জনগণই জানে। এক প্রকার যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হয় মফস্বল সাংবাদিকদের।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও চেয়ারম্যান, এআরএফবি। arfbd2011@gmail.com