তুষার আবদুল্লাহ : মেয়ের স্কুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ফুলার রোডে ছিল। তাই ওই সড়কে আমার চলাচলও ছিল নিয়মিত। হেঁটে, রিকশায় যাওয়াÑ আসার সময় খেয়াল করতাম, একদল কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছোট ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন নিয়ে সড়কের বিভিন্ন জায়গায় তারা শুটিং করছে। ক্যামেরার বদলে কেউ কেউ ব্যবহার করছে স্মার্ট ফোন। কখনও কখনও আমি দাঁড়িয়ে ওদের শুটিং দেখার চেষ্টা করেছি। কেউ গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলাচ্ছে। উদ্ভট অঙ্গভঙ্গি করছে কেউ।
আবার দল বেঁধে সার্কাসের মতো বিচিত্র আচরণ করছে। একবার জানতে চাইলাম- কোন টিভির জন্য শুটিং চলছে? উত্তর- আমাদের নিজেদের চ্যানেলের জন্য। আমি জানতে চাইলাম তাদের চ্যানেলের নাম। চ্যানেলের নামও অদ্ভুত। তবে চ্যানেলটা স্যাটেলাইট নয় ইউটিউব। এই ইউটিউব চ্যানেলের মালিক ও কুশীলবদের সঙ্গে দেখা হতে থাকে রমনা, ধানমন্ডি লেক, হাতিরঝিল, পূর্বাচলেও। কৌতূহলী হয়ে ইউটিউব ঘেঁটে তাদের নির্মাণ দেখতে শুরু করি।
শুধু উদ্ভটই নয়, শতভাগ স্থুল ওইসব নির্মাণের ভোক্তাও দেখলাম লাখ লাখ। সেখান থেকে তাদের আয় রোজগার ভালো। ইউটিউব চ্যানেলের নির্মাতাদের অনুসরণ করতে করতে দেখি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিকটকের উৎপাত। পথে ঘাটেও তাই। বিচিত্র সাজ পোশাক, চুলের ছেলে মেয়েরা প্রকাশ্যে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে ভিডিও ধারণ করছে। যা দৃষ্টি দূষণতুল্য। লোক মুখে শুনি- অনেক বেকার তরুণ-তরুণী এসবের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ আবার ইউটিউব, টিকটক তারকা খ্যাতি পেয়ে গেছে।
বাংলাদেশ থেকে সার্বিকভাবে ইউটিউবে যে কনটেন্ট বা বিষয় তুলে দেওয়া হয়, সেগুলোর মান নিয়ে বহুবার বলেছি আগেও। মানের দিক থেকে স্থূল। উৎপাদনের মূল লক্ষ্য থাকা যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া। নির্মাণ কৌশলও নিম্নমানের। এখানে বলে রাখা দরকার সংখ্যায় হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আছে, যাদের নির্মাণ গুণগত মানের বিষয়, শৈলী দুই দিক থেকেই। বাকিরা দর্শক ধরতে রুচিহীন ছবি ও সংলাপ ইউটিউবে তুলে দিচ্ছে। টিকটক অনুসরণ করতে গিয়ে দেখি, সেখানে যৌনতার ছড়াছড়ি। এখনতো সবার জানা হয়ে গেছ টিকটকের মাধ্যমে অপরাধের কতোটা বিস্তার ঘটেছে। নারী পাচার, দেহ ব্যবসা ও মাদকের মতো বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত টিকটক নাগরিকেরা।
এই যে নিম্নমানের ইউটিউব চ্যানেল ও টিকটক। এগুলোর যে লাখ লাখ ভোক্তা, এর স্বল্পকালীন নেতিবাচক প্রভাবের চেয়ে দীর্ঘসময়ের নেতিপ্রভাব রয়েছে। এগুলোর দর্শক নানা বয়সের। তবে কিশোর- তরুণ বয়সের বেশি। এই শ্রেণির দর্শকদের মধ্যে বিনোদন সম্পর্কে স্থূল ধারণা তৈরি হচ্ছে । তারা এই মানের বিনোদন উপভোগে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এমন ধারণা করার সুযোগ নেই যে স্বল্প ও শিক্ষার বাইরে থাকা জনসংখ্যাই এর ভোক্তা। শিক্ষিতরাও গোগ্রাসে এ জাতীয় বিনোদন উপভোগ করছে। ফলে বিনোদন সম্পর্কে সমাজের গড় ধারণার বদলে যাচ্ছে।
এই বদলে যাওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যমও বৈঠা বাইতে শুরু করেছে। একেবারে বাইচের নৌকার মতো। অনলাইন নিউজপোর্টাল, পত্রিকা এবং টেলিভিশনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংস্করণ লাইক, ভিউ পেতে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। প্রতিষ্ঠানের মান ও মেজাজের সঙ্গে যায় না এমন বিষয় নিয়ে খবর তৈরি করছে তারা। কিছু বাড়তি রোজগার ও খেলনাতুল্য ইউটিউব বাটন, চাবি ‘র প্রত্যাশায়।
ব্যক্তি ইউটিউবার যে নেশায় ছুটছে প্রতিষ্ঠিত টিভি, পত্রিকাও সেই একই নেশায় আক্রান্ত। এই নেশার প্রভাব তাদের মূল পত্রিকা ও টেলিভিশনকে আক্রান্ত করে ফেলেছে। কিন্তু হুঁশ নেই তাদের। ইদানিং দেখছি জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকরাও নেমে পড়েছেন ওই স্থূল ইউটিউব ও টিকটকের জগতে। বিনোদন ছাড়াও মিথ্যে তথ্য, বেহুদা তর্ক ও চিৎকার করে ইউটিউবের ভোক্তা বাড়াচ্ছেন। তাৎক্ষণিক বাহবা পেলেও, ভবিষ্যতের বিচারে তারা যে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন সেই অঙ্কটা তারা আপাতত বুঝতে পারছেন না ।
সবকিছুর ভাগ শেষ হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে আমরা এখনও স্বাক্ষরতা অর্জন করতে পারিনি। পার্কে ঘুরে ঘুরে ভিডিও করা কিশোর-তরুণদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত, জনপ্রিয় পত্রিকা ও টেলিভিশনের ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র এখন নেই বললেই চলে। এই ফারাক কমে যাওয়াটা আমাদের সকল যোগাযোগ মাধ্যমের দেউলিয়াত্বেরই পূর্বাভাস দিচ্ছে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী। ফেসবুক থেকে। জাগোনিউজ।
আপনার মতামত লিখুন :