সুব্রত বিশ্বাস: পাকিস্তানি শাসক শক্তি আমাদের ওপর একসময় যা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো, সেটার পুনরাবৃত্তি কি আমরাও ঘটাবো? নাকি আমরা বহু ভাষা, জাতি এবং সংস্কৃতির একটি গণতান্ত্রিক দেশ হয়ে উঠতে পারবো? সিদ্ধান্ত আমাদেরই হতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ ভাগ করেছে নিজেদের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ১৯০৩ সালেই ব্রিটিশ ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন ইস্ট বেঙ্গলকে আলাদাভাবে কল্পনা করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এখনও এই বাঙালি-মুসলিম বিভাজন চোখে পড়ছে। শহুরে অভিজাতদের মধ্যে খুব বেশি না হলেও ছোট শহর ও সাধারণ বাসিন্দাদের মধ্যে এই ধারণা প্রবল। মুসলিম মানে এখনও অবাঙালি এবং বাঙালি মানে কেবল হিন্দু। তুর্কি মুসলিমরা দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই দিল্লি সুলতানের গভর্নর হিসেবে শাসন করছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তারা দিল্লি শাসন থেকে বিছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠা করে, যা ওই ছোট রাজ্যগুলোকে একত্র করেছিল। তার মধ্যে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ অংশই অন্তভুক্ত ছিল।
উপনিবেশিক শাসনকালে উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রেক্ষাপটে উত্থান হয় আধুনিক বাঙলার ধারণা। পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তানে রূপান্তর হলেও দুই পাকিস্তানের মাঝে রয়ে যায় ভারতের হাজার মাইলের ভূখণ্ড। বছর না যেতেই সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক পার্থক্যগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে এবং নতুন দেশের ধর্মীয় একতাটা ক্রমে ম্রিয়মাণ হতে থাকে। এর মধ্যে ভাষা একটি শক্তিশালী ইস্যুতে পরিণত হয়।
যারা দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন তারা বেশিরভাগই ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের। তারা হায় হায় করে উঠছিলেন এই বলে যে বাঙালিকে দুভাগ করে ফেললো। এই স্লোগানটাই পরে ধীরে ধীরে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা করে। ক্রোধ ও আন্দোলন এতোটাই ব্যাপক ছিল যে, ১৯১১ সালে ব্রিটিশ শাসকরা বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বিশিষ্ট ভাষা ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহসী পাল্টা তীর ছুড়ে বলেছিলেন: ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়েও বেশী সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব সত্য।’
পশ্চিম পাকিস্তানের (বেশির ভাগই সামরিক) শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া সাধারণ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের নীতিমালা যখন জটিলতর হয়ে উঠলো, তখন সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়াটা ছিলো শুধু সময়ের ব্যাপার। লেখক : ব্যবসায়ী