শিরোনাম
◈ সাভারে শো-রুমের স্টোররুমে বিস্ফোরণ, দগ্ধ ২ ◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ চলচ্চিত্র ও টিভি খাতে ভারতের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলেই ব্যবস্থা: ইসি আলমগীর  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের

প্রকাশিত : ২৬ মার্চ, ২০২১, ০৪:৫৮ সকাল
আপডেট : ২৬ মার্চ, ২০২১, ০৪:৫৮ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ: স্বাস্থ্যখাত : শত বিশৃঙ্খলার মধ্যেও বিপুল অর্জন

অধ্যাপক ডা. বি এম আব্দুল্লাহ: গত কয়েক যুগ ধরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে কিছুটা অস্বস্তিকর এবং বিশৃঙ্খল অবস্থায় বিরাজমান। বরাবরই জনগণের মাঝেও ভয়-ভীতি, ক্ষোভ, চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কমতি নেই। ২০২০ সালের মার্চ থেকে করোনাকালীন সময়ে একদিকে যেমন চলেছে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা, অন্যদিকে উন্মোচিত হয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক নগ্ন দিক। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা টিভি খুললেই দেখা যেতো, ‘চিকিৎসা সেবা পাতালে’, ‘সেবার নামে বেহাল অবস্থা’, ‘অভিজাত হাসপাতালগুলো বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত’, ‘সরকারি হাসপাতালে বেহাল দশা’, ‘সাধারণ মানুষ জিম্মি’, ‘টাকা দিয়েও চিকিৎসা মেলে না’, ‘খোদ রাজধানীতেই অস্ত্রোপাচার করলেন ভুয়া ডাক্তার, অপারেশন টেবিলেই রোগী রেখে পালালেন তিনি, ভুল চিকিৎসায় ২০ জনের চোখ নষ্ট’ এসব চাঞ্চল্যকর অপ্রিয় সত্য কথা। করোনাভাইরাস আসার পর এই খবরগুলো বদলে গেছে। এখন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দেখা যায়, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট, হাসপাতালে হাই-ফ্লো অক্সিজেনের অভাব, হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড নেই, প্রয়োজনীয় আইসিইউর অভাব, বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে রাস্তাতেই করোনা রোগীর মৃত্যু, স্বাস্থ্য বিধি না মেনে রাস্তাঘাটে জনগণের ঢল, পর্যটন এরিয়া গুলোতে ছুটিতে জনগণের জোয়ার, স্বাস্থ্যখাতে ও ব্যবস্থাপনায় নানা দুর্নীতি- এই ধরনের বিভিন্ন সংবাদে।

একটি অপ্রিয় সত্য কথা হচ্ছে, রোগী বা জনগণের বিরাট অংশই ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি কমবেশি ক্ষুব্ধ।  তাদের অভিযোগের পাহাড়, যেমন হাসপাতালে ভালোভাবে চিকিৎসা হয় না, ডাক্তার নার্স ঠিকমত রোগীকে মনোযোগ দিয়ে দেখে না, চিকিৎসকের উচ্চ ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কমিশন ও ওষুধ কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত নানা উপঢৌকনের বিনিময়ে ওষুধ লেখা এবং অযথা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, রোগীদের সাথে খারাপ ব্যবহার, এমনকি অনেকের দৃষ্টিতে ডাক্তাররা ‘কসাই’। অভিযোগগুলো অযৌক্তিক নয়, অনেকাংশেই সত্যও বটে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যাও হাতে গোনা, সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীরা সহজে তাদের দেখা পান না, বাধ্য হয়ে সুচিকিৎসার আশায় যেতে হয় প্রাইভেট চেম্বারে। সেখানেও রোগীদের লম্বা লাইন। আবার বিশেষজ্ঞদের সিরিয়াল পেতেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাদের অনেক রোগী দেখতে হয়, তাই প্রত্যেক রোগীকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। অনেকের অভিযোগ, বেশি টাকা ফি নিলেও অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই রোগীর গায়ে হাত না দিয়েই বা কথা ভালোভাবে না শুনেই ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। এমনকি একগাদা ওষুধসহ অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন, তাও আবার নিজের পছন্দসই ল্যাবরেটরীতে। তড়িঘড়ি করে দেখার ফলে চিকিৎসকের প্রতি রোগীরা অসন্তুষ্ট হচ্ছেন ও আস্থা রাখতে পারছেন না। সামর্থ্যবান রোগীরা চলে যাচ্ছেন দেশের বাইরে। এছাড়া চিকিৎসার খরচও দিন দিন বেড়েই চলছে।  হঠাৎ কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার খরচ মিটাতে হিমসিম খেতে হয়। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম হলেও অতিরিক্ত রোগীর চাপে এবং প্রয়োজনের তুলনায় সুযোগ সুবিধা কম থাকায়, প্রত্যাশিত সুষ্ঠু চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হয় না।

বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা খরচ আকাশচুম্বী, সেখানে চিকিৎসা নেওয়া অনেকেরই সামর্থ্যরে বাইরে। ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি, পরীক্ষার-নিরীক্ষার মানহীনতা, মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্টের ব্যবহার, প্রায়ই অনেক ল্যাবরেটরির বিরুদ্ধে ভুল রিপোর্টের অভিযোগ, অদক্ষ টেকনিশিয়ান আর ভুয়া ডাক্তারের আধিক্য, এমনকি দালালদের দৌরাত্মে রোগীরা দিশেহারা। মাঝে মধ্যেই দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বিভিন্ন ল্যাবরেটরি, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে অভিযান চালান, সাথে সাথে অনিয়মের দায়ে জরিমানাও করা হয়। কিন্তু তাতে অবস্থার পরিবর্তন হয় না। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব ও প্রশাসনিক অদক্ষতায় ভরপুর, গ্রামে-গঞ্জে, উপজেলা, জেলা এমনকি বিভাগীয় পর্যায়েও, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সব মিলিয়ে সারাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হতাশাজনক চিত্রটাই ফুটে ওঠে সর্বত্র। তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে একটি বিষয়ে জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, শুধু ডাক্তার বা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে জনগণকে পরিপূর্ণ চিকিৎসা প্রদান করা কখনোই  সম্ভব হয় না। বরাবরই ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাঁধে বন্দুক রেখে পর্দার পেছনের মানুষরা পার পেয়ে যায়। এবারে করোনা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যের বরাদ্দ, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যথাযথ এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্তা ব্যক্তিদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং উদাসীনতা ইত্যাদি অনিয়মগুলোকে উন্মোচিত করে দিয়েছে এবং এগুলোই জনগণের স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

বিগত কয়েক দশক ধরে অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের অর্জন একেবারে কম নয়, সফলতা অবশ্যই যুগান্তকারী। স্বাস্থ্য বিষয়ক সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর, প্রশংসিত হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তার ওপর করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের সফলতা পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। শুরুতে করোনা সংক্রমণের প্রথম অন্তরায় হিসেবে সকলের সামনে এসেছিল চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য যথাযথ পিপিই’র অভাব। প্রথমদিকে পিপির অভাব ছিল বিশ্বব্যাপী, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস এসকল স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপকরণ উৎপাদনে মনোযোগী হয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন সারা বিশ্বে রপ্তানি করা শুরু করেছে। ফলে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনসহ করোনা যুদ্ধে ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের জন্য পিপিই-মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার শুরুতে রোগ পরীক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত। তবে টেস্টিং কিট আমদানি, দেশের বিভিন্ন স্থানে ল্যাব স্থাপনসহ পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে সে সংকটেরও সমাধান হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে পর্যাপ্ত হাসপাতাল, সুসজ্জিত আইসিইউ এবং হাই-ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহের অভাব দেখা দেয়। নানা ধরনের বাধা বিপত্তি এবং অব্যবস্থাপনার পেরিয়েও অনেক হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে প্রস্তুত করা হয়। হাই-ফ্লো অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র জনগণের জন্য সহজলভ্য ও নিশ্চিত করা হয়েছে। সময়ের সাথে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিক কোভিড যুদ্ধে সামিল হয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রোগীদের চিকিৎসা সুনিশ্চিত করে। ফলে অনেক উন্নত দেশের তুলনায়ও আমাদের দেশের মৃত্যুর হার কম। শুধু প্রতিষ্ঠান নয় এই মহামারী বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় প্রায় ৪ হাজার নতুন চিকিৎসক  এবং প্রায় ৫ হাজারের অধিক প্রশিক্ষিত নার্স নিয়োগ করা হয়।  শুধু তাই নয় মনোযোগ দেওয়া হয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দিকে, দেশের অভিজ্ঞ জনস্বাস্থ্যবিদ এবং চিকিৎসকদের সমন্বয়ে  করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে। সময়োপযোগী ও আকর্ষণীয় প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সরকার একদিকে মানুষকে বাঁচানো, আবার মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, শিক্ষার ব্যবস্থা সেগুলো যাতে ঠিক থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রেখেছে। কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া সময় উপযোগী  ও পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

তবে সব দিক বিবেচনায় সবচেয়ে যুগান্তকারী এবং ঐতিহাসিক সাফল্য হল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দক্ষতা, দূরদর্শী এবং সময়োপয়োগী সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ দ্রুততার সাথে এবং অতি স্বল্প সময়ে পৃথিবীর বড় বড় মহা শক্তিধর দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের মানুষের জন্য করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি ও সরবরাহ নিশ্চিত করা। আর বাংলাদেশে যেহেতু পূর্বেই ভ্যাক্সিনেশন প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর কাছে উদাহরণ হিসেবে সবসময় বিরাজমান ছিল,  তাই এই ভ্যাকসিন জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। ভ্যাকসিন  প্রাপ্তি এবং তা জনগণের হাতে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটি দেশের আপামর জনগণের কাছে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাছাড়া অত্যন্ত আনন্দের খবর এই যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আমাদের দেশেই তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

মার্কিন সংবাদ সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ কতৃক একটি দেশের সার্বিক কোভিড পরিস্থিতি, চিকিৎসা, মৃত্যুহার, কোভিড মোকাবেলায় দেশগুলোর প্রস্তুতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত ইত্যাদি দিক বিবেচনা তৈরি করা ‘কোভিড সহনশীলতা ক্রম’ অনুসারে পৃথিবীর ২০তম সহনশীল ও নিরাপদ দেশের তালিকায় অবস্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি ‘বিস্ময়’। ৫০ বছরের বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক, এই উন্নতি আরও হবে অদূর ভবিষ্যতে, এটাই আমাদের কাম্য। লেখক : ইউ. জি. সি. অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়