আব্দুন নূর তুষার , ফেসবুক থেকে: বিরতিহীন পড়লাম। সিরাজ সিকদারকে নিয়ে এর চাইতে ভাল কোন বই এখনো পর্যন্ত নেই।
অনেক প্রশ্নের উত্তর আছে। অনেক উত্তর অসম্পূর্ণ।
চীনের নামে সংগ্রাম। মাওবাদী ঝান্ডা যারা উড়িয়েছে তারা চীনের সাথে যোগাযোগ করেছিল কিনা এই কথাটারই কোন জবাব নাই। প্রশ্নও নাই। সিরাজ টেকনাফ পার হয়ে মিয়ানমারেই যান নাই। আর লিন পিয়াও ; মিয়ানমারের কমরেড তুন ; নিয়ে বড় বড় সার্মন দেন। বিষয়টা অদ্ভুত।
ডাকাতির টাকায় বিপ্লব করেন। যৌন অজাচার করেন। এসবও আছে। আমার শিক্ষক ও একই সাথে আরেক শিক্ষকের শ্বশুর, অধ্যাপক নাজিমুদ্দৌলা তার মানসিক ব্যারামের চিকিৎসক ছিলেন এটাও আছে। বি চৌধুরী ও জাফরুল্লাহ চৌধুরীও তার চিকিৎসা করেছেন। জাফরুল্লাহ সিরাজের দলের লোকদের নার্সিং প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
আবার কবি হুমায়ুন কবীরের কথা আছে। যার তখনো কোন কাব্যগ্রন্থ নাই। তাকে হত্যা করার পরে কন্ঠস্বরের একটি সংখ্যা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন। মাহবুব তালুকদার তার জন্য শোক করছেন। আর তার সতীর্থরা তাকে বিশ্বাসঘাতক বলছেন। তার কাছে বেআইনী অস্ত্র রাখার কথা বলছেন। বলছেন তার বোনের স্বামীর মৃত্যুদন্ডে তিনি সম্মতি দিয়েছিলেন। তিনি ছুরি চালাতেন এবং নিজের শরীরে প্রেমিকার নাম ছুরি দিয়ে লিখেছিলেন। তার পরিবারকে ২০০০ টাকা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু নির্মল সেনের অনুরোধে। সব যেনো মিলে মিশে একাকার। কে কার শত্রুমিত্র বোঝার উপায় নাই।
সিরাজকে গণভবনে নেয়া হয়েছিল কিনা এই বিষয়ে আনোয়ারুল আলম হ্যাঁ বলেছেন। ইএ চৌধুরী না বলেছেন। কিন্তু জাসদ নেতাদের তুলে নিয়ে রক্ষীবাহিনীর হাতে হত্যার কথা আছে। এ বিষয়ে সকলেই নীরব। হত্যাকারীদের বিচার কেউ চায় নাই।
সিরাজের জন্য খালেদ মোশাররফ কাঁদছেন এটাও আছে তবে তারিখটা কত সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কুমিল্লার প্যারেড প্রস্তুতি আগেই হবার কথা। প্যারেড হয়েছে ১ জানুয়ারি। তাহলে হত্যার পরে ৩ জানুয়ারি তারা ফিরবেন কেন?
জিয়াউদ্দিন মানুষ মেরে শেষ জীবনে শিশু বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। কি অদ্ভুত। রাষ্ট্রবিরোধীতার পরে সিডিএতে সরকারের চাকুরী করেছেন খালেদা জিয়ার আমলে। শাহ মোয়াজ্জেম আর কোরবান আলী সিরাজ সিকদারের পার্টির নাম দিয়ে ডাকাতি করাতেন নিজেদের লোক দিয়ে। এই কথাও বলেছেন একজন। কাদের সিদ্দিকী প্রকাশ্যে মানুষ মেরেছেন। সেটা আছে। আছে ময়মনসিংহে বাঙালির হাতে বিহারীনিধন এর কথা। বিষ্ফোরক তথ্য সব।
আমাদের জুয়েল আইচ জাহিদ নামে সিরাজ সিকদারের দলে ছিলেন কিছুদিন। সুকান্তকে সিরাজ পছন্দ করেন না কিন্তু শরৎচন্দ্রকে তার জনগণের সাহিত্যিক মনে হয়। এই বইতে আমাদের জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলন প্রসংগে সিরাজের শ্রমিক আন্দোলনের ১৯৭০ সালের ২য় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর কথা আছে আর ডিজাইনার হাসি চক্রবর্তির কথা আছে। এর সত্যতা কতটুক? সত্য হলে আমাদের ইতিহাসের দলিলে তার যথোপযুক্ত স্থান নাই কেন? এর মধ্যে বিতর্কের উপাদান আছে।
এই বইয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী লাইন। শিবুর ভাই রতনকে পার্টি হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। রতন হত্যাকারীদের বেয়নেটের সামনে বলছে ”আমারে মাইরা যদি বিপ্লব হয় তো মারেন আমারে”।
অবিমৃষ্যকারিতা, স্বেচ্ছাচারিতা আর ষড়যন্ত্র, ভয়াবহ অনিয়ম আর অন্যায়কারীরা ইতিহাসের পথে পথে। বইটা পড়ে আনন্দ পেয়েছি। সিরাজ সিকদার বিষয়ক মিথ ও রোমান্টিক কথাবার্তা যারা বলে তারা আদতে ভুল বলে। তার কবিতা লেখার মান ও হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ দেখলে তার মেধা নিয়েও সন্দেহ হয়। আরো দুঃখ হয় তার অনুসারীদের জন্য। এ এক চরম নির্বুদ্ধিতার সংগঠন। যারা নিজেরা নিজেদের ইচ্ছে হলেই মারে। বিপ্লবের নামে এ এক মাফিয়া কালচার।
আর অবাক হয়েছি। কিভাবে তরুণরা এই দেশে প্রতারিত হয়েছে নকল বিপ্লবের আহ্বানে। হায়রে স্বদেশ।
তবে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।
বিঃদ্রঃ আমি যখন শুভেচ্ছা বানাই তখন সিরাজ সিকদারের মেয়ে পরিচয়ে শিখা সিকদার নামে একজন গান গাইবেন শুভেচ্ছায় একথা বলে কয়েকবার আমার সাথে দেখা করেছিলেন। গান তেমন ভাল গাইতেন না বলে আমি তাকে সুযোগ দেই নাই। তিনি আমাকে বলেছিলেন বাবাকে নিয়ে তার তেমন স্মৃতি নাই। এই বইয়ে বলা আছে তিনি নাকি বিদেশে। এই বইতে তার পিতার কবিতা চর্চার সাথে আমি তার গান চর্চার মিল পেলাম।