আরিফুজ্জামান তুহিন : জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার রাজনৈতিক ক্ষমতা কি আদৌ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের আছে? নেই। এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সেটি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আগে আসুক, তারপর সেটি কায়েম করা হোক। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা হোক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক হিসেবে ৬৮ জনকে বীর উত্তম খেতাব দেওয়া হয়। এ তালিকায় তিন নম্বরে ছিলো জিয়াউর রহমানের নাম। সেটি শেখ মুজিব সরকারই তখন দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার দশ দিনের মাথায় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পাওয়া জিয়াও ওই হত্যাকাণ্ডে ‘পুরোপুরি’ জড়িত ছিলেন বলে জিয়াউর রহমানকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এটি তো প্রমাণ হয়নি। অভিযোগ আর প্রমাণিত হওয়া দুটি ভিন্ন বিষয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সময় রক্ষীবাহিনীর প্রধান, বিমান ও সেনাবাহিনীর প্রধানের কোনো বিচার হলো না, সব দায় জিয়ার ঘাড়ের ওপর পড়লো। দারুণ তামাশা। এভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতিকে শেষ করতে পারবে না।
যতোদিন আওয়ামী লীগ থাকবে ততোদিন আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতিও থাকবে। এখন আওয়ামী লীগ যদি মনে করে তাদের বিরোধী দল কে হবে সেটা তারা নির্ধারণ করে দেবে; বিরোধী দল হবে ধর্মভিত্তিক দলগুলো সেটা দেশের মানুষ মেনে নেবে এমনটাও নিশ্চয় আওয়ামী লীগ আশা করে না। পিকিংপন্থি কমিউনিস্টরা বহুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন যে, ২৫ মার্চের ক্রাক ডাউনের পরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভারতে পালিয়ে যান। ভারতে তারা যে ট্রেনিং নিয়েছিলেন, সেই ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে ফেরার পর বড়সড় প্রতিরোধ তারা গড়ে তুলতে পারেননি।
মূলত আগস্ট মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল), পূর্ববাংলার সমন্বয় কমিটি, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) যুদ্ধ করছিল তা তারা দখল করেছে ভারত সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মুজিব বাহিনী এ কাজে প্রধান ভ‚মিকা রাখার অভিযোগ রয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রচুর লেখাপত্র রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সব থেকে বড় লিগ্যাসি দাবি করা দল। অথচ তাদের সম্মুখ সমরে যুদ্ধের ঘটনা অন্তত পিকিংপন্থিদের থেকে কম। যুদ্ধের একদম শেষ দিকে ১১ নভেম্বর ভারতের আগরতলা থেকে সিপিবির একটি দল বাংলাদেশে ঢোকার সময় কুমিল্লা-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা নামক স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর মুখে পড়ে যায়। ওই যুদ্ধে নয়জন কমরেড শহীদ হন। স্থানটি দেখেই বুঝতে পেরেছেন তারা বাংলাদেশে ঢোকার মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখে পড়ে শহীদ হন।
গোটা যুদ্ধে সিপিবির এটাই সব থেকে বড় বীরত্বপূর্ণ লড়াই। এখন এই আস্তিক-নাস্তিক, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ-বিপক্ষ এইরকম অতি অপ্রয়োজনীয় ফালতু বিতর্ক তো দেখা যাচ্ছে খোদ আওয়ামী লীগ সরকার টিকিয়ে রাখছে। একজন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধার খেতাম এভাবে কেড়ে নিয়ে বরং জিয়াউর রহমানকে আরো প্রাসঙ্গিক করে দিচ্ছে। মনে রাখতে হবে দুনিয়াতে এভাবে ইতিহাস থেকে কাউকে বাদ দেওয়া যায় না। বরং এই ডিনায়েলের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানকে ইতিহাসে অমর করা হলো। বিএনপিতে রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এখনো অনেকে জীবিত আছেন। তাদের উচিত তাদের প্রত্যেকের খেতাব ফিরিয়ে দেওয়া। এর মধ্যে একজন আছেন মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ বা মেজর হাফিজ। মেজর হাফিজকে ভারতীয় বাহিনী টাইগার হাফিজ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এটি আমার শোনা ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদকের নিজের মুখে। তো মেজর হাফিজ একটি বই লিখেছেন, নাম গৌরবময় একাত্তর থেকে রক্তাত্ব পঁচাত্তর। এ বই নিয়ে কেন হইচই হচ্ছে না বুঝলাম, বইটি রীতিমতো বোমা।
একাত্তরের আগে ও পরে পিকিংপন্থিদের কীভাবে রাষ্ট্র খুন করেছে তার কিছু বিবারণ আছে। আছে, বীরত্বপূর্ণ একাত্তর সাল নিয়ে ভয়াবহ বর্ণনা। যারা মার্চে পালিয়ে ছিলেন, সেইরকম সময় মেজর হাফিজ যশোর ক্যান্টনমেন্টে, তিনি জানতেন না দেশে ২৫ মার্চ কালোরাতের ঘটনা, পাকিস্তান বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের ঘটনা। এমন কী স্বাধীনতার ঘোষণা, বিভিন্ন স্থানে বাঙালিদের বিদ্রোহের ঘটনাও তার জানা ছিল না। সেরকম একটা অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা মেজর হাফিজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তিনি তার সৈন্যদের নিয়ে বিদ্রোহ করবেন। তিনি বিদ্রোহ করে যশোর ক্যান্টনমেন্টের ঘেরাও থেকে যুদ্ধ করে বেরিয়ে আসেন।
আমি চাই জিয়াউর রহমানের খেতাব ফিরিয়ে নেবার পর মেজর হাফিজ তার বীর বিক্রম উপাধিটি ফিরিয়ে দেবেন। সতীর্থ রাজনীতিকের প্রতি এতোটুকু সম্মান তার মতো যারা আছেন তাদের দেখানো উচিত। এতে বরং খেতাব বর্জনকারীরা ইতিহাসে মহান হয়ে থাকবেন। পদক নিয়ে বরং তারাই থাক, যারা চেতনাকে সকাল বিকেল আলু, পটলের মতো বিক্রি করে। আওয়ামী লীগের শত্রু কিন্তু জামায়াত ইসলাম না, অন্যান্য ইসলামি দলতো নয়ই। আওয়ামী লীগের প্রধান শত্রু বিএনপি। জিয়াউর রহমানের খেতাব ফিরিয়ে নেবার প্রক্রিয়া থেকে এটি স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ বিএনপির নাম নিশানা নিশ্চিহ্ন করতে চায়। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :