স্বপ্না রেজা: অল্প বয়সের কেউ যখন বিপথগামী হয় তখন বড়দের, বিজ্ঞদের দেখি। বড় ও বিজ্ঞদের কথা শুনি। তারা বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেন, ছোটদের দোষ খোঁজেন। নৈতিক অবক্ষয়ের অজুহাত দিয়ে বিবৃতি, বক্তৃতা দেন এবং নিজেদের জ্ঞান জাহির করবার একটা সুযোগ পেয়ে যান। স্বল্পজ্ঞানীরাও বসে থাকেন না। নিজের বুঝ অনুযায়ী তারাও কথা বলেন, মন্তব্য করেন। সকলের মন্তব্য, বক্তব্য যোগ করলে এই সমাজে আর কারোরই বিপথে যাবার কথা নয়। যেহেতু বক্তব্য ও মন্তব্যগুলি বেশ সচেতনভাবে সকলে করে থাকেন যাতে নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়টি বেশ পরিস্কার হয়ে ওঠে। এমন বক্তা তো ঘরে ঘরে। এই সমাজটা তো এই রকম মানুষ দ্বারাই গঠিত। এতে ভেবে নেয়া যায় নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের আকাল নেই এইদেশে। আদতে কী তাই ? বোধহয় না। মানুষ যখন কথা বলেন তখন তিনি তার ছায়া থেকে বেরিয়ে অন্যের দিকে তাকিয়ে সেই কথা বলেন। ফলে কথা কথাই হয়ে থাকে, নৈতিক মূল্যবোধ মিছে হয়ে বাঁচে। বলা যায় বাংলাদেশে এরকম মানুষের সংখ্যাই বেশি।
সম্প্রতি আনুষ্কা ও দিহান এর ঘটনাটি সারা দেশের আলোচ্য বিষয়। হবারই কথা। ধর্ষণকামী সমাজব্যবস্থায় দিহান এর মতন সন্তান থাকা কতটা অযৌক্তিক সেটা ভেবে দেখার দায়িত্ব বোধহয় কমবেশি সকলের। নিশ্চয়ই কেউ দ্বিমত পোষন করবেন না যে দিহান জন্মগতভাবে একজন ধর্ষক নয়। সে এই পৃথিবীতে জন্মেছে আর সব নবজাতকের মতোই। কিন্তু বেড়ে উঠেছে একজন ধর্ষক কিংবা বিকৃত যৌনকামী পুরুষ হয়ে এবং সেই বেড়ে ওঠা এই সমাজে, মায়ের গর্ভে নয়। শিশু যা দেখে পরবর্তীতে সেটাই সে দেখাতে চেষ্টা করে এবং যা শোনে সেটাই সে অন্যকে শোনাতে পছন্দ করে। এই দেখা-শোনার শিক্ষা কেবল পরিবারে হয় না। বরং পরিবারের বাইরে যে দেখা-শোনার মহাসাগর, সাঁতার না জানলে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে, সেখানেই। দিহানের মতন একজন অল্প বয়সী মানুষ জীবনে কী কী দেখেছে, শুনেছে তার একটি তালিকা করলে নির্ঘাত অজগরের মতন ভয়ংকর কিছু একটা বেরিয়ে আসবে এবং যেটার বিস্ফোরণ সম্ভবত ঘটেছে আনুষ্কার সাথে বিকৃত যৌন আচরণের মাধ্যমে। যারা সমাজ গঠনে নিবেদিত তারা কী কখনো জানবার চেষ্টা করেছেন, আমাদের সমাজের ছেলেমেয়েরা কী দেখছে, ভাবছে, শুনছে ? যদি সেটা জানবার চেষ্টা থাকতো তাহলে নিশ্চিত ছেলেমেয়েদের জন্য কী দেখানো, শোনানো যায় তার একটা তালিকা সমাজ ও রাষ্ট্রে এতোদিনে তৈরি হয়ে যেত এবং তারা অনবরত সোচ্চার থাকতেন এই একটা বিষয়ে। অন্ততঃ বুলি সর্বস্ব চেতনার আর কাউকে গল্প শুনতে হত না।
একজন সাব-রেজিস্টার দিহানের বাবা। অগাধ ধনসম্পদের মালিক। অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ধনসম্পদের কথা শুনে। বাংলাদেশে যে এটা কোনো ব্যাপারই না বিস্মিতরা সেটা বেমালুম ভুলে গেছেন ক্ষণিকের জন্য হলেও। সাব-রেজিস্টার ও ডিষ্ট্রিক রেজিস্টারদের অধিকাংশই যে অগাধ সম্পদের মালিক হন বিশেষ প্রক্রিয়ায়, সেই কথা তো কমবেশি সকলেই জানেন। পাশাপাশি নাগরিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অনেকেরই আছে প্রচুর ধনসম্পদ এবং তা ছোটবড় দায়িত্বের মাঝে বিসৃত, কে না জানে সেসব কথা। দিহানের বাবার মতন লোকের ধনসম্পদ হয় কী করে এতো, এই প্রশ্নের জবাব সততার সাথে ‘কর্তৃপক্ষ’ পাবার চেষ্টা করলে হয়তো অবৈধ আয়ের পথ খোলা থাকতো না। আর দিহান কৈশরে তার বাবার কাছ থেকে উপহার হিসেবে আসল গাড়ী পেত না, খেলনা গাড়ি পেত। আর ‘নৈতিকতার পথ’ও তার কাছে অস্পষ্ট হত না। দিহানের এই অনেতিক ও বিপথগামীতার পেছনে কী সেইসব উদাসীন কিংবা মদদ দাতা রূপী ‘কর্তৃপক্ষ’[ দায়ী নন কোনভাবেই ? উত্তরটা পাঠককে খুঁজতে অনুরোধ করছি।
এবার প্রচারমাধ্যমের কথা বলি। এমন ধরনের ঘটনা ঘটলে সংবাদের বেশ খোড়াক জোটে। কয়েকটি বেসরকারি টিভিতে বলা হলো, ‘গ্রুপ স্টাডির কথা বলে বাসা থেকে ডেকে মাস্টার মাইন্ডের ‘ও’ লেবেল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত দিহান মেপেল লিপ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘এ’ লেবেল এর শিক্ষার্থী।’ বলার সাথে সাথে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ছবি ও নাম দেখানো হলো। এমন তথ্য উপস্থাপনে সমাজে কী প্রভাব পড়তে পারে একবার ভাবুন পাঠক। প্রথমে বলি গ্রুপ স্টাডির কথা। গ্রুপ স্টাডিতে পড়াশোনা করা নতুন কিছু নয়। প্রকৃত গ্রুপ স্টাডিতে পড়ালেখা করতে শিক্ষার্থীরা বেশ পছন্দ করে। এতে শেখাটা অতিদ্রুত ও সহজ হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত অস্বচ্ছল অভিভাবকদের পক্ষে প্রাইভেট টিউটর কিংবা সাবজেক্ট অনুযায়ী কোচিং এ তাদের সন্তানদের ভর্তি করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। তখন ছেলেমেয়েরা গ্রুপ স্টাড করে। দিহানের বিকৃত যৌনাচরণ কিংবা ধর্ষণের বিষয়টি গ্রুপ স্টাডির সাথে বারবার উপস্থাপনের ফলে অভিভাবকদের মনে গ্রুপ স্টাডি সম্পর্কে এক ধরনের ভয়, ভীতি ও আতংক তৈরি হতে পারে অতিসহজে। এতে গ্রুপ স্টাডির প্রতি অভিভাবকদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জন্মাতে পারে, সন্তানের গ্রুপ স্টাডির বিষয়ে অনাগ্রহতা দেখা দিতে পারে।। ফলে গ্রুপ স্টাডির মতো একটি কার্যকর শিখন প্রক্রিয়া প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীণ হতে পারে। অন্যদিকে শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠতে পারে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম বলা কী খুব জরুরি ছিলো ? কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ও দালানবাড়ি দেখানো ? এই বলা ও দেখানোতে ঐ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুইটিতে অধ্যায়ণরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মনে আতংক, সংশয় তৈরি হতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে। এ ধরনের নিউজ আইটেম এ মনে হয় যে, এক স্কুল আর এক স্কুলকে রেপ করেছে। কিংবা যত ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপ এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুইটি ইংলিশ মিডিয়াম। মানসিক সংকীর্ণতার কারণে আমাদের সমাজে অনেকে আবার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও তার শিক্ষার্থীদের ভালো চোখে দেখেন না। তারা এমন ধারনা পোষন করেন যে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়ারা বেপরোয়া। যদিও বাংলা মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষাথীরাও নানান ধরনের অনাকাংখিত অনৈতিক ঘটনা ঘটায়। যৌন হয়রানির ঘটনা সেখানেও ঘটে। ফলে ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ এই সংস্কৃতির ভাবাপন্ন সমাজে মাস্টারমাইন্ড ও মেপল লিপ স্কুলের নাম উচ্চারিত হবার সাথে সাথে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রতি সংকীর্ণদের মাথা আবার চড়াও হবার সুযোগ পেয়েছে।
একটি জাতীয় পত্রিকার কলামে একজন লেখক ‘আনুষ্কা যেভাবে নিজে রক্ষা পেতে পারতো’-এই শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলেন। তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়েছে নারী যৌন হয়রানির শিকার হবেই এবং নিজেকে তার নিজেই রক্ষা করতে হবে। কীভাবে রক্ষা পেতে পারতো তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। অবাক হয়েছি এই ভেবে যে, নারীর প্রতি সহিংসতাকে কীভাবে মেনে নেয়া হচ্ছে লেখনীতে ! যাইহোক, লেখা ও সংবাদ পরিবেশনের সময় সচেতন হওয়া দরকার প্রচারমাধ্যমের। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে প্রচারমাধ্যমের একটা বড় ভুমিকা আছে মনে রাখতে হবে।
টিভির ভিউয়ারস কিংবা পত্রিকার সার্কুলেশন দিয়ে নয় প্রচারমাধ্যমের যোগ্যতা ও স্থান নির্ধারন হওয়া দরকার রাষ্ট্র, সমাজের প্রতি তার দায়-দায়িত্ব, দৃষ্টিভঙ্গির গুনগত মান দিয়ে। পরিশেষে বলি, আনুষ্কার হত্যার বিচার যেমন হতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে একজন দিহান ধর্ষক হয়ে বেড়ে উঠবার পরিবেশ, পথকে নির্মূল করতে হবে। মূলতঃ ধর্ষক হয়ে বেড়ে উঠবার পরিবেশ, পথ নির্মূল হলেই আনুষ্কারা নিরাপদ হবে, বেঁচে যাবে।
স্বপ্না রেজা: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক