সাদিয়া নাসরিন: বৃহষ্পতিবার রাতে বাসায় ফেরার সময় আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা হারিয়ে গেছে। কাকলির ট্রাফিক সিগন্যালে এক সুদর্শন সার্জেন্ট গাড়ি থামিয়ে কাগজ পত্র চেক করার সময়ই অন্যপাশে এক মেজরের গাড়ি একসিডেন্ট করলো। মেজর সাহেবের গগন বিদারি হুঙ্কারে বেচারা এদিক ওদিক হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে লাইসেন্সটা কোথাও ফেলে দিয়েছেন।
কী অদ্ভুত না? কিন্তু দুনিয়ার সব অদ্ভুত বিষয় আমার সাথেই হবে।
যাই হোক, আমি বাসায় চলে এলাম। এর মধ্যে তিনি কয়েকবার ফোন করে অনুরোধ করলেন, আমি যেনো ঠান্ডা মাথায় একবার গাড়িতে খুঁজে দেখি। আমিও মনের গহীন গোপন আশা নিয়ে পুরো গাড়ি, শপিং ব্যাগ ট্যাগ যা ছিলো সব খুঁজলাম। জানতাম নেই, তবুও আশা কুহেলিকা...
শুক্রুবার সকাল বেলা সেই ভদ্রলোক ফোন দিয়ে জানালেন, তিনি নিজে পুলিশ বক্স, রাস্তা, ফাঁড়ি, গাড়ি সবখানে খুঁজেছেন, কোথাও নেই। রাতে কিছুটা আশা তবু ছিলো, সকালে ফোন পেয়ে নিশ্চিত হলাম, আমার যা যায় একেবারেই যায়।
এরপরেই কী জানি হলো, অনেকদিন পর তীব্র মন খারাপ হলো। যেমন তেমন মন খারাপ নয়, কলিজা ছেঁড়া মন খারাপ। লাইসেন্স তুলতে ঝামেলা টামেলা এসবের জন্য কিছুনা, এই একটুকরো লাইসেন্স যে আমার কতোটুকু ছিলো, সেটা বুঝতে লাগলাম যতোবার মনে পড়ছিলো সেটি নেই, ততোবার।
জানি, লাইসেন্স আবার পাবো। কিন্তু কোনওকিছুর কি আসলে রিপ্লেসমেন্ট হয়?
যাই হোক, শুক্রুবার এমন তীব্র মন খারাপের বিকেলে আমার ছেলে বললো, মা, মন খারাপ হলে চলো বাইরে ঘুরতে যাই। আমি তোমার মন ভালো করে দিতে পারবো মনে হয়।” কোনদিনও আমার এরকম মন খারাপ হলে বাচ্চাদের সঙ্গ ভালো লাগেনা, ক্লান্ত লাগে। কিন্তু এবার কেনো জানি ইচ্ছে করলো।
গাড়িতে ওঠেই সে ব্লুটুথ অন করে গান দিলো, “মন মোর মেঘের সঙ্গী”...আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি কিভাবে জানলা যে আমি এই গানটাই শুনতে চাইছিলাম!! সে বললো, তুমি গুনগুন করছিলা...
এরপর সে একে একে আমার প্রিয় সব গান শোনালো। আমাকে নার্সারিতে নিয়ে গেলো, টব কিনতে নিয়ে গেলো...থানায় নিয়ে গেলো জিডি করতে, কতো কথা বললো!!
এবং সব কাজ শেষ করে ফেরার সময় আমাকে তার টাকায় দইফুচকা খাওয়ালো। একশ বিশ টাকা প্লেট!!
ফুচকা খেয়ে বললো, “মা, ফুচকা এমন একটা জিনিষ, খেলেই সবার মন ভালো হয়ে যায়। এখন বলো তোমার মন ভালো হইসে?” ..আমি বললাম, এইটি পার্সেন্ট ভালো হইসে। সে জানতে চাইলো বাকি টুয়েন্টি পার্সেন্ট কি করলে ভালো হবে? আমি বললাম, গাছ লাগালে।
সে বললো, “ওহ মা!! দেন আই কান্ট হেল্প মাইসেল্ফ...আমি গাছ লাগাতে পারিনা। তবে রাতে বাসায় গিয়ে ড্রিল করে তোমার নতুল ওয়ালমেটগুলো লাগিয়ে দেবো। দেখি কাজ হয় কিনা!!”
আমি এরপর থেকেই একটা ঘোরের মধ্যে আছি। তাহলে আমার ছেলেটা বড় হয়ে গেলো!! ওর সঙ্গ আমার ভালো লাগলো!! একটা বিকেল তবে একা আমার ডালিমকুমারের সাথে কাটানো যায়!! সত্যিই সে এমন কেউ হয়ে ওঠলো যে আমার পুরোটা পড়তে পারে!!
যে সময়ে ঝুরঝুরে বালির মতো হাতের মুঠি খুললেই সব সম্পর্ক ঝরে পড়ে যাচ্ছে, নিজের বাবা মায়ের সাথেও কাঁচের দেয়ালটা ক্রমেই পুরো হচ্ছে, ভাই বোনেরা সব অচিনপুরের পথিক, বন্ধুরা সব আস্তিনের নিচের সাপ, সেই সময়ে নিজের রক্তই কি শুধু এঁটেল মাটির প্যাক কাদা হয়ে হাত আঁকড়ে ধরে? এই জীবনে ব্যথার গায়ে আরাম দিতে কেবল নিজের সন্তানই পারে তবে!!
এই সুখ এমন সুখ!!
ফেসবুক থেকে