ফিরোজ আহমেদ: বোরখা পরা এক নারীর ক্রিকেট খেলার ছবি নিয়ে কিছু মন্তব্যে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। একটা পুরনো কথা মনে করিয়ে দিই, ভারতবর্ষে বোরখা নামের পোশাকটির উদ্ভব ঘটেছিলো অভিজাত নারীকে গতিশীলতা দেওয়ার জন্যই। এর আগের অন্তঃপুরবাসিনীদের কেউ কেউ স্বামীদের চাকরি কিংবা ব্যবসা সূত্রে নানান স্থানে যাওয়া শুরু করলেন। সেই যাতায়াতটিকে সম্ভব করে তোলার জন্যই ব্রিটিশ আমলে বোরখার আবির্ভাব। এর আগে এই পোশাকটির উল্লেখ্য আসলে তেমন পাওয়া যায় না। ট্রেন কিংবা স্টিমারের মতো বাহনে সবাই ব্যক্তি, প্রথম বা তৃতীয় শ্রেণি যাই হোক। ফলে পালকি, ডুলি বা এই সকল অভিজাত ব্যক্তিগত ঘেরাও সেখানে সম্ভব ছিলো না আর। সম্ভবত সমাজবিজ্ঞানীরা এটিকে একটা অগ্রগতি-প্রগতি হিসেবেই দেখবেন। দরিদ্র নারীরা বাধ্য হতেন তুলনামূলক কম পোষাক পরতে। সেটা তাদের সচেতন বিদ্রোহ ছিলো না। বা স্থায়ী সংস্কৃতিও না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক সঙ্গতি হওয়া মাত্রা যাদের জীবন ও পোশাক এবং সংস্কৃতি ভিন্ন শ্রেণির ছিলো। তাদেরই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। মানে মধ্য শ্রেণিকেই তারা শালীন পোশাকের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ৮০ পরবর্তী সময়ে ৯০ দশক থেকে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে এই বিষয়টা খুব স্পষ্ট করে দেখতে পাবেন।
মোনাজাতউদ্দীনের লেখাগুলোর সাথেও মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। পোশাকের সংস্কৃতির আরও বহু বদল ঘটছে, ঘটতে থাকবে। পাকিস্তান আমলে বাঙালি মধ্যবিত্ত ও অভিজাত সমাজের খুব ছোট একটা অংশ পশ্চিমা পোষাকে অভ্যস্ত হন। পোশাকের আসলে ভালোমন্দ কিছু নেই, আছে ব্যক্তিগত ও পারিপাশির্^ক রুচির ছাপ, আছে আর্থিক সামর্থ্য, শ্রেণি, রুচি, মতাদর্শ সহ বহু কিছুর একটি জটিল ব্যাকরণ। একটা কোনো তথ্য দিয়ে তার সব কিছু বুঝে ওঠা কঠিন। কিন্তু সেই ছোট অংশটির কিছু আলোকচিত্র ব্যবহার করে প্রগতিশীলতা থেকে আমাদের সমাজের ‘তালেবানি’ হয়ে যাবার সম্ভাবনা আবিষ্কার করাটা একটা ভয়াবহ গোঁড়ামি, ধর্মীয় মতান্ধতার চাইতে সমাজের জন্য এটা কম ক্ষতিকর কিছু না। বরং সাংস্কৃতিক মাফিয়াগিরি আর মাতব্বরির কিছু ক্ষমতাকাঠামোর কারণে এটার সমাজে শত্রু কাতারে বিভক্ত করবার মতো শক্তিসম্পন্ন। খুব সংক্ষেপে বললে, স্কার্ফ পরা (কিংবা না পরা) যে মেয়েটা আজকে গ্রামীণ পটভূমি থেকে উঠে এসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা যশোরের এমএম কলেজ বা রংপুরের কারমাইকেল কলেজে পড়ছে, তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংগ্রামের সামাজিক অভিঘাত ষাটের দশকের খুবই সংখ্যাল্প একটা অংশের পশ্চিমা পোশাক পড়ার তুলনায় অনেক, অনেক বেশি। এটা অনেক বেশি প্রগতিশীল ঘটনা, এর তাৎপর্য পোষাক দিয়ে স্থুলভাবে মাপতে গেলে থই মিলবে না।
নারীর স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তৈরি হওয়া এসবের পথে এই সমাজকে যারা গঠন করেছেন, তাদের জীবনের ঘাত-অভিঘাতগুলোই বেশি কার্যকর। তারা পড়াশোনা করছেন, খেলছেন, নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন-এই হলো সত্যিকারের অগ্রগতি। পোশাক বিষয়ে আরও বহু ‘আধুনিকতাবাদী’ কুসংস্কার আসলে আমাদের সমাজকে গ্রাস করে আছে, যা আসলে সমাজের সাথে থেকে সেখানে প্রগতিশীল কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল উপাদানগুলোকে না সন্ধান করে ঊনিশ শতকে তৈরি হওয়া বাঙালি পোশাকের একটা ধারণা সমাজের ওপর চিরস্থায়ীভাবে চাপিয়ে দিতে চায়। যে মেয়েটাকে গণপরিবহনে উঠতে হয়, যাকে গ্রামীণ ও নাগরিক সমাজের রূপান্তরের চাপ সামলাতে হয় এবং এমনকি যার নিজের ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে একটা সংবেদনও তৈরি হয়েছে, আবার হয়েছে আধুনিকতা ও চলতি পোশাকের ধারণা সম্পর্কে, এবং এমন আরও বহু কিছু মিলেই আমাদের পোষাকের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি গড়ে উঠছে, উঠতে থাকবে। কোনো একটা প্রবণতাই একক ও সর্বগ্রাসী হবে না। সেটা হবার চেষ্টা করা হলেই বরং অনাবশ্যক হানাহানি বাড়তে থাকবে। কিন্তু সম্ভবত এই উপনিবেশিক মনোবৃত্তির অন্যের সংবেদনশীলতা বুঝতে না চাওয়া আধুনিকরা একটা আরও বহুকাল গোয়ার্তুমি অটুট রাখবেন। অথচ খেয়াল করবেন না যে বাংলাদেশের আশির পরবর্তী সময়ে এমনকি আমাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্তি মায়েদের গৃহস্থালী পোষাকেও (যার নিশ্চিতভাবেই মৌলবাদী ধর্মান্ধ নন) শাড়ি অনেকটা জায়গা হারিয়েছে, সেটা একটা আনুষ্ঠানিক-বেড়াতে যাবার পোষাকে পরিণত হয়েছে। বৃটিশ আমলের সূচনাকালী পুঁজিবাদের স্টিমারের চাইতেও দ্রুত গণপরিবহন, দ্রুততর সমাজের তাড়া আমাদের পোষাকে আরও বহু বদল আনবে।
এমনকি প্রজন্মান্তরে আরও বদল হবে। বিষয়গুলোর আরও বহু জটিলতা ও দিক আছে। এইখানে যতোটা সহজভাবে সম্ভব কিছু কথা বলবার চেষ্টা করলাম। নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানান বাঁকবদল, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অভিঘাত সমেত আরও বহু কিছু আছে। একজন বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ বলেছিলেন, মার্কিন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগে, গুয়ানতামো বে এবং আবু গারিব কারাগারের আগে কোন মুসলমান আত্মঘাতী হামলাকারীকে পাওয়া যাবে না, জাতিয়তাবাদী এবং আরও নানান ধরনের আত্মোৎসর্গ করা তরুণকে পাওয়া যাবে। আমাদের দেশেও পশ্চিম বিরোধী এই ঘৃণা কতো প্রবলভাবে ছড়িয়েছে, তা আমরা দেখেছি নৃংশস সব হামলাতে। আবার অন্যদিকে আজকের দুনিয়ায় কেউ যে কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না, সেই উপলদ্ধিও অধিকাংশ মানুষের আছে। অন্যদিকে শুধু আন্তর্জাতিকত চাপ দিয়েই সমাজকে বিবেচনা করা যায় না, সমাজের নিজের ভেতরেও গতিপথও আছে। আমাদের দেশে পোশাক নিয়ে আমরা আজকে যা দেখছি, হুবহু সেই বিতর্কগুলো মিশরে কয়েক দশক আগে ঘটে গেছে। আমাদের পরে এই রূপান্তর শুরু হয়েছে মালয়েশিয়াতে এবং আমাদের আগেই অনেকখানি এই বিষয় মিটে গেছে। অনেকগুলো জটিলতা জায়মান সেখানেও, তারপরও সম্ভবত অর্থনীতির চাকা একটু জোরে ঘুরে নগরায়নকে দ্রুতগামী করে খানিকটা স্থিতু হয়েছে। শিশুটির সাথে মায়ের ক্রিকেট খেলার অনিন্দ্যসুন্দর ছবিটা বহুকাল মনে গেঁছে থাকবে। কিন্তু এই ছবিটাকে কেন্দ্র করে যে বিতর্কগুলো আমরা দেখলাম, সেটাও আমাদের মধ্যবিত্তের একটা বেশ ছোট মামুলি অংশের ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা আর অসংবেদনশীলতার অংশ। (আমি অনেক সুস্থ। এখনও কণ্ঠনালীল খানিকটা দুর্বলতার কারণে কথা বলা থেকে বিরত থাকছি। কিন্তু চিকিৎসকরা খানিকটা স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজকর্মে উৎসাহই দিয়েছেন।) ফেসবুক থেকে