ডেস্ক রিপোর্ট : [২] নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত ধাক্কা সামলে উঠতে মাত্রই ফের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ফিরতে শুরু করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। তবে এক্ষেত্রে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহনের সামনে হাজির হয়েছে এক অভিনব সংকট। মহামারী চলাকালীন বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের মতো অতিজরুরি পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতে নিজেদের চুক্তির মেয়াদ কয়েক মাস পর্যন্ত বাড়িয়েছিলেন কার্গো জাহাজের কয়েক লাখ নাবিক। কিন্তু কোনো ধরনের বিরতি ছাড়াই স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সময় সমুদ্রে অবস্থানের কারণে বর্তমানে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। চেপে ধরেছে তীব্র অবসাদ ও ক্লান্তি। এ অবস্থায় তারা আর এক মুহূর্তও জাহাজে থাকতে চাইছেন না।
[৩] বিশ্বের মোট নাবিকদের প্রায় অর্ধেকের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন দি ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন জানিয়েছে, করোনাকালে জরুরি ভিত্তিতে বাড়ানো নাবিকদের চুক্তির মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কাজ চালিয়ে না যাওয়া ও নাবিকদের বাড়ি ফেরার আইনি অধিকার নিশ্চিতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সবকিছু করা হবে। আর দক্ষ নাবিকদের বড় একটি অংশ এ পদক্ষেপ নিলে বিপাকে পড়বে বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল।
[৪ ]জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডের (ইউএনসিটিএডি) তথ্য অনুযায়ী, পরিমাণের দিক দিয়ে বৈশ্বিক পণ্যবাণিজ্যের ৮০ শতাংশই সম্পাদিত হয় সমুদ্রপথে জাহাজের মাধ্যমে। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস পুরো শিপিং ইন্ডাস্ট্রিকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য বন্দরগুলোয় জাহাজ ভেড়ানোর ক্ষেত্রে জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা। একই সঙ্গে বন্ধ করে দেয়া হয় বিমানবন্দরগুলোও। ফলে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কর্মী স্থানান্তর অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় নিয়মিত চুক্তি শেষ হওয়া নাবিকদের স্থলে নতুন নাবিক নিয়োগ দেয়াও সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে কার্গো পরিবহন অব্যাহত রাখতে মার্চে শিপিং কোম্পানি ও ইউনিয়নগুলো নাবিক বদলের নিয়মিত প্রক্রিয়া স্থগিতের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে। কিন্তু সমস্যা হলো, তাদের এ সিদ্ধান্ত ছিল সীমিত সময়ের জন্য। অথচ বাস্তবে নাবিকদের জাহাজে অবস্থান করতে হচ্ছে দীর্ঘকাল।
[৫] দি ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের ডেভ হেইনডেল এক বিবৃতিতে বলেন, কিছু নাবিক আছেন, যারা টানা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জাহাজে অবস্থান করছেন। তাছাড়া এই মহামারীকালে বিভিন্ন দেশের সরকার তাদেরকে এমনকি তীরে একটু হাঁটার জন্যও অনুমতি দেয়নি। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে জরুরি চিকিৎসাসেবা দিতেও অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। সত্যি বলতে, অন্তহীন এই দুর্ভোগ নাবিকরা আর সহ্য করতে পারছেন না। তারা বর্তমানে নিজেদের ‘ভাসমান বন্দি’ হিসেবে অভিহিত করছেন।
[৬] বিশ্বের বৃৃহত্তম কনটেইনার শিপিং কোম্পানি মায়েরস্ক জানিয়েছে, তাদের ৬ হাজার ৬০০ নাবিকের প্রায় ৩৫ শতাংশ বর্তমানে সমুদ্রে অসহায়ের মতো অবস্থান করছেন। আগেই তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও তারা জাহাজ ছাড়তে পারছেন না। তারা ঠিক কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, সে বিষয়েও এখন পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় নাবিকদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা ও অবসাদগ্রস্ততা বাড়ছে। সত্যি বলতে, নিরাপত্তা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তাদেরকে এভাবে দীর্ঘ সময় বন্দিদশায় রাখা উচিত নয়।
[৭] দি ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের মহাসচিব স্টিভ কটন জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদেরকে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে। ঠিক কতজন নাবিক জাহাজ থেকে চলে আসবেন কিংবা কাজ বন্ধ করে দেবেন, সে বিষয়ে এখনই কোনো পূর্বাভাস দেয়া যাচ্ছে না। তবে এরই মধ্যে শুধু গত সপ্তাহেই ফেডারেশনের কাছে এ বিষয়ে পরামর্শ চেয়ে ফোনকলের পাশাপাশি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছেন কয়েক হাজার নাবিক।
[৮] ফেডারেশনের সর্বশেষ এ কার্যক্রমকে ‘বৈশ্বিক শিপিং স্থগিতের ডাক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন হংকংভিত্তিক শিপিং কোম্পানি ওয়ালেম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফ্রাঙ্ক কোলে। ফ্রাঙ্ক দাবি করেন, এ খাতে যে মানবিক সংকট রয়েছে, তা নিরসনে সরকারগুলো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আর এ কারণেই বর্তমানের এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মেরিটাইম লেবার কনভেশন অনুযায়ী, একজন নাবিক ১১ মাস পর্যন্ত সমুদ্রে অবস্থান করতে পারেন। কিন্তু মহামারীর কারণে অনেক নাবিক রয়েছেন, যারা টানা ১৫ মাস পর্যন্ত জাহাজে ভেসে বেড়াচ্ছেন। বিষয়টি খুবই অমানবিক ও বিপজ্জনক।
সিএনএন বিজনেস, বণিক বার্তা
আপনার মতামত লিখুন :