সৈয়দ আতিকুর রব : লাদাখ সীমান্তে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে ভারত এবং চীনের উত্তপ্ত পরিবেশের মধ্যে বাংলাদেশকে দেওয়া চীনের ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগকে ভারতের সংবাদমাধ্যম মোঠেও ভালো চোখে দেখছে না । এ নিয়ে তাদের গোত্রদাহ শুরু হয়েছে । স্বল্পোন্নত বাংলাদেশকে দেওয়া চীনের এই বাণিজ্য সুযোগ ভারতের গণমাধ্যমের ভাষায় ‘খয়রাতি’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে । ১৫ই জুন লাদাখে আসলে কি ঘটেছিল তা নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে খোদ ভারতে। একতরফাভাবে চীনের ওপর দোষ চাপালেও এখন নিজেদের কথায় তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যার ফলে দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক চাপে পড়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, চীন চুক্তি ভঙ্গ করে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতীয় ভূখণ্ডে কোনো দেশের সেনারা প্রবেশ করেনি। বরং ভারতীয় সেনারা চীনকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে। ফলে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, চীনা সেনারা ভারতে প্রবেশ না করলে ভারতীয় সেনাদের হত্যা করলো কারা? তাহলে কী ভারতীয় সেনারাই চুক্তি ভঙ্গ করে চীনের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়ায় সমালোচনা চলছে দেশটিতে। যার ফলে লাদাখে চীনা আগ্রাসন মোকাবেলায় ভারত অনেকটা নড়বড়ে অবস্থায় পড়েছে। সীমান্তে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে ঠিকই কিন্তু রনকৌশল তৈরীর লক্ষ্যে মোদি সরকারের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরিস্কার নয় এখনও। এ ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা ও অস্পষ্ট । লাদাখের ঘটনার পর মিত্র শক্তিদের কাছে পাচ্ছে না ভারত। অনেকটা সঙ্গিহীন মোদি সরকার। কৌশলগত স্বার্থ উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বড় বান্ধব আর কেউ নেই ভারতের। সেই যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা নিশ্চুপ তাদের দূর্দিনে। এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের সুসস্পর্ক নেই পূর্বের মত। চির বৈরী পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে চীনের বলয়ে। অতিসম্প্রতি আবার নেপালও ভারতীয় ভূখণ্ডের একাংশ নিজেদের দাবি করে মানচিত্র সংশোধন করেছে। শ্রীলঙ্কা ও ভূটানের সঙ্গেও আগের মতো সম্পর্ক নেই নয়াদিল্লির।
মলদ্বীপে কিছুটা হলে জমি পুনরুদ্ধার করেছে ভারত তবে সেখানে ও চীনের প্রভাব বাড়ছে ধীরে ধীরে। এহেন প্রেক্ষাপটে ভারতের অন্যতম প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক সুবিধা দিয়ে কূটনৈতিক খেলায় ভারতকে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছে বেইজিং। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের হলেও ভারতীয় মিডিয়া মনে করছে, নয়াদিল্লির সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ঢাকাকে বাগে রাখার ‘টোপ’ এটি বেইজিংয়ের। লাদাখে যাই ঘটুক কিন্তু ভারতের কিছু মিডিয়া বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু করায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিষ্টচার বর্হিভূত এহেন সংবাদ যা- ভারত বাংলাদেশের চলমান বন্ধু সুলভ সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে বিশিষ্টজনরা মনে করছেন ।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে রফতানি সুবিধা পেয়ে এসেছিল। মাঝে কিছু জটিলতার কারণে সে সুবিধায় ভাটা পড়েছে। সম্পর্কের খাতিরে চীন আগে থেকেই বাংলাদেশের কয়েক হাজার পণ্যের রফতানি সুবিধা দিয়ে আসছে। সম্প্রতি সেই সুবিধার জায়গায় যোগ হলো আরও পাঁচ হাজারের বেশি পণ্য। যাহা প্রথম জুলাই থেকে কার্যকর হবে। বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক বোঝাপড়ার ফলে এ ধরনের সুবিধা পাওয়া যায় এবং চীন থেকে বাংলাদেশ সেটাই পেয়ে আসছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। তাছাড়া দেশের পদ্মাসেতুসহ বহু মেগা প্রকল্পে চীন ও সেদেশের নানা কোম্পানি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেদিক বিবেচনায়ও বলা যায়, বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগে বোঝাপড়া হুট করেই কয়েকদিনে হয়নি। এটি হতে সময় লেগেছে দীর্ঘদিন । তাহলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে কেনো এ রফতানি সুবিধাকে ‘সীমান্ত উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে’ দেখা হচ্ছে এবং তা-ও ‘খয়রাতি’ হিসেবে, তা নিয়েই এখন আলোচনা সর্বত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী এ বিষয়ে তার ফেসবুকে আনন্দবাজার পত্রিকার সমালোচনা করে লেখেন, ‘খয়রাতির টাকা গ্রহণে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ যোজন যোজন দূরে!’
তিনি বিশ্বের উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন দেশের আর্থিক সাহায্য গ্রহণের কিছু চিত্র তুলে ধরে সেখানে লেখেন, ‘খয়রাতি বা দানের টাকা হিসেব করলে দেখা যাবে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ যোজন যোজন দূরে। বিশ্বের উন্নয়ন সহায়তা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আর্থিক সাহায্য পায় (আনন্দবাজারের ভাষায় খয়রাতি) এমন দেশগুলোর মধ্যে টাকার অঙ্কে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সাহায্যপ্রাপ্ত দেশটির নাম ভারত, আার বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। জার্মানির কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য যে দেশটি পেয়ে থাকে তার নাম ভারত (পরিমাণ প্রায় ১১৮২ মিলিয়ন ইউএসডি)। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান পঞ্চম (পরিমাণ ৪৬৬.৩৭ মিলিয়ন ইউএসডি)। জাপানের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে ভারত (পরিমাণ ২৩৭৬.৪০ মিলিয়ন ইউএসডি)। এছাড়া ফ্রান্স ও হাঙ্গেরি থেকেও মোটা অঙ্কের সাহায্য পেয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এ দেশটি।’ সাংবাদিক আতাউর রহমান আনন্দবাজারের এ প্রতিবেদনটি তার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লেখেন, ‘বাংলাদেশকে নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার এমন ভাষা প্রয়োগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। নিজেরা বাংলাদেশ নিয়ে অসম বাণিজ্যের খেলা খেলবে, আর অন্য কোনো রাষ্ট্র সেই বাণিজ্যে সমতা আনলে সেটা খয়রাতি হয়?’
চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি কি আসলেই বাড়বে?চীন এক বছরে বাংলাদেশে যা রপ্তানি করে, বাংলাদেশ এক যুগেও তা রপ্তানি করতে পারেনি চীনে! উভয় দেশের এই অসম বাণিজ্য কিছুটা কমে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে চীনের গত বুধবারের এক সিদ্ধান্তে। তবে চীন এমন এক সময় বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এলডিসির তালিকায় বাংলাদেশের থাকার কথা রয়েছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। সে হিসাবে চীনে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুযোগ পাওয়া যাবে বড় জোর আর চার বছর। তবু ও চীনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের রপ্তানিকারকেরা। তবে সুবিধার বিষয়টি পুরোপুরিই নির্ভর করছে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য শেষ পর্যন্ত চীনের তালিকায় আছে কি না, তার ওপর। গতকাল শনিবার পর্যন্ত চীন এ বিষয়ে কোনো তথ্য বাংলাদেশ সরকারকে জানায়নি। যে ঋণকে ভারতের গণমাধ্যম খয়রাতি বলে আখ্যা দিয়েছে সেই খয়রাতির জালে ভারত নিজেই যে জর্জরিত সেটি তাহারা বেলুম ভূলে গেছে । ত্রিদেশীয় চাপে পড়ে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা ও ২৪ ঘণ্টার মতো সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে এমন খবর প্রচার নিজেদের ‘অসহায়ত্ব’ লুকানোর নামান্তর । ডাবলিন/আয়ারল্যান্ড