ভূঁইয়া আশিক রহমান : ‘বাবা’ গভীর মমতায় বুকে টানেন, ভালোবাসেন, বিপদে সাহস সঞ্চার করেন, বলেন- এগিয়ে যা!
জন্মদাতাকে অনেকেই- ‘বাবা’, কেউবা ‘পাপা’, ‘ডেডি’ কেউ কেউ ‘আব্বু’ বলেই ডাকেন। আমরা ডাকতাম ‘আব্বা’ বলে। চার ভাই- বোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। আমার ছোট একজন, দুজন বড়। তিন বোনের এক ভাই আমি। বড় আপার সঙ্গে আব্বার হইচই টাইপের সম্পর্ক ছিলো না, তবে তার বিয়ে হয়েছিলো মহা ধুমধামে। আব্বা তাকে খুব ভালোবাসতেন, তবে কথাবার্তায় প্রকাশ পেতো না। আপার বিয়ে হয় ৮৮ সালে, সেই বিয়ের কার্ড যখন ২০১৫ সালে দেখি, তখন বিস্ময়ের সীমা থাকে না। আমি তো ‘থ’! অজপাড়া গায়ের একটি বিয়ে, যা ১৯৮৮ সালে, সেই বিয়ের দাওয়াত কার্ড এতো সুন্দর! অবিশ^াস্য হলেও খুবই সুন্দর ছিলো বিয়ের কার্ডটি।
মেঝ বোন আনু, ওর সঙ্গে আব্বার খাতির ছিলো বেশি। তার প্রতি অনেক বেশি নির্ভর ছিলেন তিনি। টাকাপয়সা, দলিল-দস্তাবেজ জমা রাখার ব্যাংক ছিলো সে। সুবিধা নেওয়াতে ওস্তাদ ছিলো আনু। কারণ খাতির করতে পারতো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। বড় আপা ও মেঝ’র চেয়ে ছোট বোন মনি আব্বাকে খুব বেশিদিন পায়নি। ৯৭ সালে যখন আব্বা মারা যান, তখন ওর বয়স সাকুল্যে ৭ বছর। আমি ছিলাম এগারো বছর বয়সী। আমাকে নিয়ে আব্বার প্রকৃত প্রতিক্রিয়া কেমন ছিলো, কিশোর আশিকের পক্ষে তা বোঝা খুব সহজ ছিলো না। তবে এখনো মনে আছে, পুকুরে গোসল করার সময় প্রায় আব্বার সঙ্গী হতাম। সাতার জানতাম না তখনো। ফলে পানিতে তার গলা ধরে ঝুলে থাকতাম। দুষ্টুমি করতাম। পানি ছিটাতাম। আহা! আমার মহাআনন্দের দিনগুলো।
আমার আব্বা একজন কৃষক ছিলেন। পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। বাজার সংলগ্ন ছিলো আমার স্কুল। যখন তাকে বাজারে পেতাম, আমার দুই টাকার আবদার মেটাতে হতো তাকে। সামনে দাঁড়ালেই বুঝতেন- কী চাই আমি। তবুও একগাল হেসে বলতেন, কী চাস? হেসে বলতাম, দুই টেকা দেও। টাকা দুই দিতেন, তবে সঙ্গে কড়া উপদেশ থাকতো- স্কুলে যা, পড়ালেখা কর, নাইলে হালানি যাবি! আব্বা পড়ালেখার প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলেন। নিজে পড়ালেখা করতে না পারলেও পরিবারের সদস্যদের পড়ালেখার প্রতি বেশ সচেতন ছিলেন। সৎ ও সতর্ক থাকতেন। তার আনন্দ হতো পরিবারের সদস্যদের পড়ালেখার সাফল্যে। নিজের ছোট ভাই যখন গ্রাজুয়েট (৮০ দশক) হয়েছিলো, তার বাঁধভাঙা আনন্দ দেখার মতো ছিলো। পাড়াঘুরে সবাইকে বলতো, ভাইয়ের পড়ালেখার সাফল্য। প্রাইমারি স্কুল পড়া আমাকে যখন একদিন লুঙ্গি পরার চেষ্টা করতে দেখলেন, তার প্রতিক্রিয়া ছিলো দেখার মতো। বড় বড় করে হেসে পাড়া কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন!
নিজের ঢোল নিজে বাজানোর মতো হলেও, বলতে হয়- আমার আব্বা ছিলেন অনেক সরল অথচ খুবই বুদ্ধিমান। ছিলেন বিচক্ষণ। যারা তাকে চেনেন, এই গল্পের সত্যতা সম্পর্কে তারাই বলতেন। এখনো কেউ কেউ বলেন আমাকে। পাড়ার অনেক বিচার-আচারে তাকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হতো। যে কারও সংকটে পাশে থাকতেন, অর্থ দিয়ে না পারলেও নিজের উপস্থিতি দিয়ে সহযোগিতার প্রয়াস থাকতো। নিজের পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও অন্যের দুঃখের কাতর হতেন। সংগ্রামী জীবন ছিলো তার। তবুও এই সংগ্রামকে তিনি কখনোই কঠিন করে দেখতেন না। সবকিছুকে তুচ্ছজ্ঞান করে এগিয়ে যাওয়া বিশ^াসী মানুষ ছিলেন তিনি।
একজন প্রকৃত ‘বাবা’ গভীর মমতায় সন্তানকে বুকে টানেন, ভালোবাসেন, বিপদে সাহস সঞ্চার করেন, বলেন- ভয় কীসের, এগিয়ে যা, আমি আছি তো। বাবারা এমনই হন।
দুনিয়ার সব ‘বাবা’র প্রতি শ্রদ্ধা। ভালোবাসা।