মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: করোনা ভাইরাস এখন আর আগের ভাইরাসের মতো আঞ্চলিক অবস্থানে নেই। এটি এখন বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নিয়েছে। যখন চীনে এটি প্রথম হানা দিয়েছিলো তখন চীনারা প্রাণপণে যুদ্ধ করেছিলো এর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। অন্য দুনিয়ার মানুষরা দূর থেকে করোনার আক্রমণ দেখেছে। কিন্তু কেউ ভাবতে পারেনি করোনা সুনামির মতো ক্ষীপ্রতায় বিশ্বের প্রায় সকল অঞ্চলকে ডুবিয়ে দেবে। পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো এখন করোনা সুনামিতে প্রায় তলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশ থেকে আমরা চীনাদের করোনা পরাস্তের আপ্রাণ চেষ্টা দেখেছি। কিন্তু আমাদের দেশে তখন কিছু মানুষ করোনাকে ভিন্ন শক্তির ভিন্ন ‘শাস্তি’ হিসেবে উপস্থাপন করে তথাকথিত সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের প্রচারণা চালিয়েছিলো। বিষয়টি আমাদের রাষ্ট্র,সমাজ ও মানুষের মূল্যবোধের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ন নয়। তারপরও একটি গোষ্ঠী তেমন প্রচারণায় মানুষকে আবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু এসব প্রচারণা করোনা-সুনামির কাছে কতোটা শক্তিহীন, দুর্বল তা প্রচারকদের বোঝার কথা নয়। করোনা ঠিকিই অন্যদের যেমন আক্রমণ করেছে, আমাদের ভূখ-েও এর ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে। আমরা জানি না এর ঢেউ কতোদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, কতো মানুষ এর ঢেউয়ের নিচে তলিয়ে যাবে। তবে এরই মধ্যে অনেক কিছুই আমাদের বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, কলকারখানা বন্ধ না হলেও কতোদিন টিকে থাকবে বলা মুশকিল। ব্যবসায়-বাণিজ্য বলতে গেলে বন্ধ প্রায়। ওদিকে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও প্রতিদিনই দুঃসংবাদ বাড়ছে। কিছু কিছু অঞ্চল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। সব চাইতে দুশ্চিন্তার কারন হচ্ছে করোনার স্পর্শকাতরতা এখনো নির্ধারণ করতে না পারা। ফলে ডাক্তার ও নার্সরা আক্রান্তদের সারিয়ে তোলার চেষ্টা করবেন এমন সুযোগটিও তো এখনো সৃষ্টি হয়নি।
পৃথিবীতে নানা ধরনের ভাইরাস অতীতে এসেছিল। যখন এসব ভাইরাস সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিলো না তখন মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। মানুষ তেমন দুর্যোগে অসহায়ত্বের সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে অতিপ্রাকৃতিক শক্তিকে আহবান জানিয়েছে তাকে সমুদ্রে তলিয়ে না নিতে, কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের কাছে সেই মানুষরা আত্মসর্মপণ করে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলো। মহামারির ছোবল থেকে যারা বেঁচে ছিলেন তারা এটিকে দৈবশক্তির করুণার বিষয় হিসেবে দেখেছিলেন। আদিম ও প্রাচীন যুগে সেই কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস একসময় মানুষ অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিলেন।
মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের একটি বড় সময় পর্যন্ত প্ল্যাগ, পীতজর, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, কালাজর, কলেরা, যক্ষ্যা ইত্যাদির মহামারির কথা সকলেরই জানার বিষয়। এসব মহামারিতে লাখ লাখ মানুষ বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই মৃত্যুর মিছিলে অনেক রাজা বাদশার নামও রয়েছে। পরাক্রমশীল নেপোলিয়ান বোনাপার্টের ছোট বোনের জামাতা হাইতির ফরাসি শাসক চার্লস লিক্লার্কও পীতজরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৮০২ সালে। এই তালিকায় আরো অনেক সম্রাট, রাজা-বাদশার নাম লেখার আছে। সেই তালিকা দীর্ঘ নাই বা করলাম। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ মহামারি কেনো পৃথিবীর অনেক জটিল জটিল রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ উদ্ভাবন করেছে। সুতরাং, নতুন ভাইরাস হিসেবে করোনা প্রতিষেধকও উদ্ভাবনে জগতের জ্ঞানীগুনী মানুষরা চেষ্টা করে চলছেন, সফলও হবেন। কিন্তু আমাদের দেশের এক শ্রেণির অনলাইন ইউজার এবং গুজব, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস ছড়ানো ব্যক্তিরা মেধা, মনন, জ্ঞান, বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার পথ এড়িয়ে যা করছেন তা বিবেক ও বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাজের পর্যায়ে পড়ে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। করোনা-সুনামির আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর চাইতেও বিশ্বব্যাপী মানুষের আর্থ-সামাজিক সংকটকে ভয়ানকভাবে তীব্রতর করতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই সুনামি প্রলম্বিত হলে বৈশ্বিক অর্থনীতি মহাসংকটে পড়তে পারে। অনেক দেশ করোনার সংক্রমণে ক্ষতির চাইতে অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে। তাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে কিনা সেটি বড় প্রশ্ন। পৃথিবী তেমন সঙ্কটে পড়লে পশ্চাৎপদ দেশগুলোর মানুষের খাদ্য সংকট কিভাবে মোকাবেলা করা হবে সেটিও একটি দুর্ভাবনার বিষয়। তবে সাড়ে সাতশো কোটি মানুষ যদি নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে তাহলে এসব ভাইরাসের তা-ব জয় করা মোটেও অসম্ভবের কিছু নয়। আমাদের দেশেই চার দশক আগে লবন, চিনি ও পানির সংমিশ্রনে স্যালাইন উদ্ভাবন করে ডায়রিয়া-কলেরার আক্রমণ প্রতিহত করার উদাহরণ রয়েছে। আমরা সেই সৃজনশীলতার কথা এখন কেনো ভুলে গেলাম? কেন কুসংস্কার আর অজ্ঞানতাকে নিয়ে আমরা বিভ্রান্তির চোরাগলিতে প্রবেশ করছি? আমরা চোরাগলিতেই বা চোরাবালিতেই আটকে থাকি না কেন পৃথিবীর অন্যত্র করোনার-সুনামি পরাস্ত হবেই। সুতরাং আমাদের দৃষ্টি কোনদিকে নিবদ্ধ হবে- সেটিই ভেবে দেখার বিষয়। লেখক : শিক্ষাবিদ।