আরিফ জেবতিক
উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এবং সদ্য প্রাক্তন মেয়র আতিকুল ইসলামকে আমি প্রায় ছোটবেলা থেকে চিনি। নব্বই দশকের শুরুতে যে তরুণ উদ্যোক্তারা বিজিএমইএতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে ‘সম্মিলিত’ নামের প্যানেলের নেতৃত্বে আমার বড় ভাই নুরুল হক ইকবাল, আজকের মেয়র আতিকুল ইসলাম, এমপি ফুটবলার সালাম মুর্শেদি সবাই মোটামুটি সমবয়সী এবং একই প্যানেলের নেতা ছিলেন। সেই সূত্রে তাদের ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে। আনিস ভাই অন্য প্যানেলের নেতা হলেও তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিলো। সেই সূত্রে আমি জানি আজকে আতিকুল ইসলামকে নিয়ে যে ট্রল করা হচ্ছে, এই স্বভাবটা তার ‘নির্বাচনী স্বভাব’ নয়। তিনি ব্যক্তি হিসেবে এ রকমই। এই যে হুট করে চাওয়ালার দোকানে বসে চা খাওয়া বা এ রকম হৈচৈ করা তার স্বভাবসুলভ ব্যাপার।
গত কয়েক বছর আগে ( তখনো তিনি মেয়র হননি বা রাজনীতিতে আসবেন এমন কোনো লক্ষণই ছিলো না।) তখন তিনি বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট। এক গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। গায়ে হলুদে ব্যাপক নাচগান হচ্ছে। তিনি বললেন, ‘জেবতিক চলো একটু নেচে ফেলি’। তারপর তিনিও হিন্দি গানের তালে দুকদম নেচে ফেললেন। সুতরাং এই যে পূজার আসরে গিয়ে ঢোল বাজানো কিংবা চায়ের দোকানে বসে চা বানানো, এগুলো আমার কাছে তার নির্বাচনী স্ট্যান্টবাজি মনে হয়নি। তিনি যদি মেয়র নাও হন, তবু দেখা যাবে যে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের পিকনিকে গিয়ে একইভাবে লোকজনের পাতে রোস্ট তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যারা তার নির্বাচনী প্রচার প্রোপাগান্ডার দায়িত্বে আছেন, তাদের সবার ঘিলু মিলিয়েও এক চা চামচ হবে কি না আমার সন্দেহ। আতিকুল ইসলামের এই স্বভাবসুলভ ফ্রেন্ডলিনেসকে তারা নির্বাচনী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। এতে করে মানুষ বিরক্ত হচ্ছে। আতিকুল ইসলাম হয়ে উঠছেন হাসির পাত্র। অথচ আতিকুল ইসলামের নির্বাচনী ইস্যু হওয়া উচিত ছিলো সত্যিকার জনবান্ধব ইস্যুগুলো। যেমন এই ডেঙ্গু মহামারীর সময়ে তিনি কিন্তু দক্ষিণের মেয়রের মতো ফাউল টক দেননি। যদিও অনেক দেরিতে শুরু করেছেন, তবু আমি মনে করি তিনি আন্তরিকভাবে এটা মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছেন। ঢাকা নর্থ সিটিকে ব্লক হিসেবে ভাগ করে ব্লক বাই ব্লক ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা, তল্লাশি করা, মশার ওষুধ ছিটানোÑ এসব কাজে তিনি নিজেও করপোরেশনের কর্মচারীদের সঙ্গে রাস্তাঘাটে ছিলেন। বারিধারায় এই কাজ করতে গিয়ে আছাড় খেয়ে নিজের পা ভেঙেছেন। তিনি বলতে পারতেন আগামীতে ডেঙ্গু-চিকনগুনিয়া রোধে তিনি কী কী পদক্ষেপ নেবেন। এই যে সারা শহর ‘স্মগে’ ছেয়ে আছে, বিশ্বের সবচাইতে খারাপ বায়ু দূষণ এই শহরে, সেটি বন্ধ করতে তার পরিকল্পনা কী। তিনি বলতে পারতেন, ঢাকা শহরে মোট কয়টি পাবলিক টয়লেট তিনি প্রথম বছর, দ্বিতীয় বছর, তৃতীয় বছরে করবেন। তিনি জানাতে পারতেন, শহর পরিষ্কার রাখতে তিনি কী কী করবেন। যেহেতু মেটাল ডাস্টবিন চুরি হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে তার বিকল্প চিন্তাভাবনা কী। যে ইউলুপগুলো এখনো করা যায়নি, সেগুলো করার ক্ষেত্রে তিনি কী কী ভূমিকা নেবেন। ‘ঢাকা চাকা’র মতো করে শহরে অন্য কোনো রুটে বাস চালাবেন কি না, স্কুলগুলোকে স্কুলবাস দিতে তিনি কী ভূমিকা রাখবেন। কোন কোন মাঠ তিনি উদ্ধার করে শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করে দেবেন। জন্ম নিবন্ধন, মৃত্যু নিবন্ধন সেবাকে কীভাবে দুর্নীতিমুক্ত ও ঝামেলামুক্ত করবেন। স্কুল, কোচিং সেন্টার, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এসব সিটি করপোরেশনে বাধ্যতামূলক নিবন্ধন করতে হয়, এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবা নিশ্চিত করতে তিনি কীভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করবেন। সিটি করপোরেশনের সেবা নিশ্চিত করতে হটলাইন সেবা কীভাবে দেয়া যাবে। এ রকম অনেকগুলো সমস্যার সমাধান আসলে সিটি করপোরেশন মেয়রের হাতে। এই ইস্যুগুলো নিয়ে কথাবার্তা বলা দরকার ছিলো। তা না করে ‘মেয়র হলে মাদকের বিরুদ্ধে সিনেমা বানাবো’ তার এই বক্তব্যগুলোকে নিয়ে তার প্রচার টিম সগর্বে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। বর্তমান ‘নির্বাচনী সিস্টেমে’ আতিকুল ইসলাম উত্তরের মেয়র পদে নির্বাচিত হতে কোনো বাধার মুখে পড়বেন বলে আমার মনে হয় না। তিনি হয়তো নির্বাচনে জিতবেন ঠিকই, কিন্তু এই প্রচার টিমের আবলামির কারণে তিনি বারবার ট্রলের শিকার হতেই থাকবেন এটাই দুঃখের বিষয়। ফেসবুক থেকে