মাজহারুল ইসলাম : কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে বেশ কটি গ্যাং গড়ে উঠেছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অপরাধ কর্মকান্ড দিন দিন বাড়ছে বলে নানা পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। গত শনিবার রাতে টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুটি গ্রুপের গোলাগুলিতে একজন নিহত হয়। এতে প্রশ্ন উঠছে, এতগুলো নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি ও কড়া নজরদারী সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র পৌঁছাচ্ছে কীভাবে। বিবিসি বাংলা
যদিও পুলিশ বলছে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে গত শনিবার রাতের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে দুটি ডাকাত দলের মধ্যে। পুলিশের ভাষ্যমতে, এসব সশস্ত্র অপরাধী দলের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩০ বছর আগে আসা হাকিম ডাকাত গ্যাং এর নাম। নতুন গড়ে উঠেছে জকির ও ছলিম ডাকাত গ্রুপ। এসব গ্যাংগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কক্সবাজারের অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা র্যা ব ১৫'র অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, এসবের কেন্দ্রে রয়েছে নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবার ব্যবসা ও এর টাকা ভাগাভাগির বিষয়। তিনি আরও বলেছেন, এখানে কিছু ডাকাত গ্রুপ আছে যারা ইয়াবার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। রোহিঙ্গারা মারামারি করে ইয়াবার ব্যবসার টাকা ভাগাভাগি এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। এছাড়াও ক্যাম্পের ভেতরের বাজার থেকে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন গ্রুপের নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা পয়সা সংগ্রহ করে। এটিও তাদের নিজেদের মধ্যে কলহের একটি কারণ। র্যা বের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, গত ৩০ বছর ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আছে। যাদের বয়স তিরিশের নিচে এদের মধ্যে অনেক রোহিঙ্গার জন্মই বাংলাদেশে। দেশি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এদেরও সম্পর্ক রয়েছে।
বিশ্বের সবচাইতে বড় শরণার্থী শিবির কক্সবাজারে ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস করছে। র্যাব কর্মকর্তা উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলছেন, এর মধ্যে নয়াপাড়া ক্যাম্পে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী কার্যক্রম হচ্ছে। তারা ইয়াবা, মানব পাচার ও ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত রয়েছে পুলিশ, র্যা ব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। একসঙ্গে এতগুলো বাহিনীর উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও কিভাবে রোহিঙ্গারা এতো অপরাধী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, সব জায়গায় পাহারা শক্ত নয়। এখানে যেসব সন্ত্রাসী গ্রুপ আছে তারা পাহাড়ে থাকে, ক্যাম্পে অবস্থান করে না। পাহাড় থেকে নেমে তারা এসব অপরাধমূলক কাজগুলো করে। তিনি আরও বলেছেন, ক্যাম্পগুলোর চারদিকে খোলা, ফলে ইচ্ছে করলেই যে কেউ যে কোনো দিক দিয়ে বের হতে ও ঢুকতে পারে। এ সুযোগটাই ওরা নেয়। বিশ্বের অন্যান্য যায়গায় যেসব ক্যাম্প আছে, সেগুলো একটা সংরক্ষিত জায়গায় থাকে। চারদিকে বেষ্টনী থাকে। বিভিন্নভাবে তাদের আটকানোর একটা ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমাদের সেটা নাই। ক্যাম্পের ভেতরে বেশিরভাগ যায়গায় কোন রাস্তা নেই। পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, আমাদের কিছু লিমিটেশন আছে। ক্যাম্পের ভেতর পর্যাপ্ত রোড না থাকায় কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা যানবাহন নিয়ে সেখানে ঢুকতে পারি না। এছাড়া ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাদের অনুপাতে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জনবল সংকট।
জানা যায়, গত দুই বছরে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অন্তত ৪৫টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয় আরও ৩২ রোহিঙ্গা।
র্যাবের উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলছেন, হেলিকপ্টার দিয়ে আমরা ওদের আস্তানাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। ড্রোনের মাধ্যমেও তাদের পজিশন বা পাহাড়ে তাদের আস্তানা খুঁজে বের করার একটা রেকি করেছি। এতে আমরা কিছু জায়গা চিহ্নিত করেছি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খন্দকার ফারজানা রহমান। তিনি জানান, সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে পালিয়ে আসা এ জনগোষ্ঠী বিশ্বব্যাপী শরণার্থী হিসেবেই চিহ্নিত এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সহযোগিতা ও সহানুভূতি তাদের প্রতি রয়েছে। এসব কারণে রোহিঙ্গাদের অপরাধী কর্মকান্ডে আইনের আওতায় আনা কিছুটা জটিল। তার মতে, রোহিঙ্গারা এমন একটা জায়গা থেকে এসেছে, এমন একটা নির্যাতন, নিপীড়নের মধ্যে থেকে এসেছে যে সাইকোলজিক্যালি তারা এক ধরনের কনফ্লিক্ট ক্যারি করে। তাদের মধ্যে অনেক ধরনের ট্রমা ডিপ্রেশন কাজ করে। এই ধরনের নেগেটিভ ইমোশন থাকলে সেখানে অপরাধ বেশি হবেই। ১৯৩০ সালের শিকাগোর ইতিহাস পড়ে জানা যায়, সেখানেও একই ঘটনা ঘটেছিলো। সেখানে ইমিগ্র্যান্টরা এতোই নেগেটিভ ইমোশন্স ছিলো যে, সেখানেও ক্রাইম বেড়ে গিয়েছিলো।