লাভা মাহমুদা : ছোটবেলায় ভূগোল বইতে যে নামগুলো পড়ে মনে শিহরণ জাগতো তা হলো পৃথিবীর বৃহত্তম বন, বৃহত্তম নদী, বৃহত্তম মহাসাগর, বৃহত্তম মহাদেশ ইত্যাদি। তখনই আমাজনের নামটি প্রথম জানা হয়। এখন মহাকাশ নিয়ে ভাবলে যেমন মনে হয় পৃথিবীর বাইরের কিছু, আমাজন নিয়ে ভাবনাটাও তখন তেমনই ছিলো। মনে হতো পৃথিবীর বাইরের কিছু। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে, আমাদেরও বেড়েছে জানার পরিধি। আগে নিজের বাড়িটিকেই শুধু বাড়ি মনে হতো, এখন পুরো পৃথিবীটিকেই নিজের বাড়ি মনে হয়। যে আমাজন অরণ্যকে একসময় দূরের কোনো গ্রহ মনে হতো, অনেক তথ্য উপাত্ত জানার পর সেটিই আমার অনেক অনেক আপন, অনেক কাছের ।
৭০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সর্ববৃহৎ এ অরণ্যটি দক্ষিণ আমেরিকার ৯ টি দেশ জুড়ে বিস্তৃত। বনের ৬০শতাংশ ব্রাজিলে, ১৩শতাংশ পেরুতে আর বাদবাদি অংশ কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানায় অবস্থিত। পৃথিবীর রেইন ফরেস্টের অর্ধেকটাই এই অরণ্য এবং পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০শতাংশ আসে এই অরণ্য থেকে। সেজন্যই চিরহরিৎ এ অরণ্যটি আরেক নাম ‘পৃথিবীর ফুসফুস’। সপ্তাশ্চর্যের একটি এই অরণ্যের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী আমাজন নদ। এখানে বৃক্ষ রয়েছে ৩৯০ মিলিয়ন, ৪৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরিসৃপ এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তনপায়ী প্রাণী আছে, আর আছে হাজার প্রজাতির বৈচিত্র্যময় জীব-অনুজীব। আমাজন নদীতে তিন হাজার প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী আছে। এখানকার জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী, যে কারণেই এখানে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বৈচিত্র্যময় প্রাণিজগৎ টিকে আছে। এই বনে তিনশয়ের বেশি উপজাতি বাস করে। তারা বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়, কথা বলে পর্তুগীজ, স্প্যানিস ইত্যাদি ভাষায়। এছাড়াও এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা,সংস্কৃতি,বহিঃবিশ্বের সাথে তাদের তেমন যোগাযোগ নেই।
বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীর ফুসফুস এখন লোভের আগুনে জ্বলছে, আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ (ইনপে) জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে আমাজনে রেকর্ডসংখ্যক দাবানল হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার ৮৩ শতাংশ বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে এবং তা ব্রাজিলিয়ান অংশেই ঘটেছে। ধারণা করা হয়, গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসা ব্রাজিলের ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোর ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটছে। কারণ ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার তিনি বলেছেন যে, ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্রাজিলের উচিত আমাজনকে উন্মুক্ত করে দেয়া। যাতে খনন, কৃষি ও কাঠ ব্যবসায়ীরা এর সম্পদকে কাজে লাগাতে পারে।
জীববৈচিত্র্যের আধার ঐ বনটি ধ্বংসের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে বিশ্ববাসী, ক্ষোভে ফুঁসছে ব্রাজিলসহ সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁখোসহ বিশ্বনেতারাও এগিয়ে এসেছেন। আর মুখে শরীরে বিদ্রোহের রঙ কমলা মেখে, তীর হাতে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন সেই আদিবাসীরা, যাদের জীবন জীবিকা এবং বেঁচে থাকার উৎসই হলো এ অরণ্য। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষত-বিক্ষত এ পৃথিবী । উন্নত শিল্পসমৃদ্ধ দেশের ঢেলে দেয়া কার্বনে উষ্ণতা বেড়েছে এ গ্রহের। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের দেশের মতো প্রান্তিক দেশগুলো। গলছে এন্টার্কটিকার বরফ, গলছে গ্রীনল্যান্ডের বরফ, গলছে হিমালয়সহ আর সব পর্বতের বরফ। অদূর ভবিষ্যতে ডুবে যাবে পৃথিবীর স্থলভাগের অনেক অংশ । আবার এই অরণ্য ধ্বংস হলে ঘাটতি হবে অক্সিজেনের। আমরা আসলে এক শ্বাসরুদ্ধকর পৃথিবীর বাসিন্দা হতে চলেছি। শিল্পের নামে, সভ্যতার নামে আমাদের গন্তব্য এক অসভ্য জগৎ, যে জগতে মৃত্যুই শুধু হাতছানি দিয়ে ডাকবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
আপনার মতামত লিখুন :