এইচ এম জামাল: চা উৎপাদনের ১৬৫ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ । চায়ের সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ কোটি ২৩ লাখ কেজি। উৎপাদিত হয়েছে ৮ কোটি ২০ লাখ কেজি যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯৭ লাখ কেজি বেশি। চা শিল্পের উন্নতি হলেও বদলাচ্ছে না চা শ্রমিকদের জীবন। ডেইলী ষ্টার
সারাদিন কাজের পর একজন চা শ্রমিকের আয় ১০২ টাকা, নেই নিজস্ব নৃতাত্তি¡ক জাতিগত পরিচয়, লেখাপড়ার সুযোগ নেই, নেই স্যানিটেশনও। রয়েছে চিকিৎসার অভাব। শিক্ষিত হলেও ১০২ টাকা রোজের নির্দিষ্ট কাজ করতে হয় নয়তো হারাতে হয় মাথা গোজার জায়গা। কাজ করতে গিয়ে অঙ্গহানি ঘটলেও কোনো সাহায্য নেই। নিজের অধিকার নিয়ে যেনো সোচ্চার না হতে পারে সেজন্য মালিকপক্ষের সহযোগিতায় নেশার ঘোরে রাখা হয় শ্রমিকদের। পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি চা বাগানে রয়েছে মদের দোকান।
এমনি হতভাগ্য জনগোষ্ঠী চা শ্রমিকরা। ব্রিটিশ শাসনামলে সুন্দর জীবনযাত্রার লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন স্থানে আনা হলেও শুরু থেকেই তাদের কপালে জুটেছে অবহেলা-নির্যাতন। জুলেখা চা বাগানের চা শ্রমিক মেনকা সাঁওতাল বলেন, স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়ে গেলেও চা বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যে পরিবর্তন আসেনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি তাদের জীবনযাত্রায়। এমনকী, মৌলিক অধিকারও তারা ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। চা বাগানের এই জনগোষ্ঠী এখনও ব্রিটিশ সামন্তবাদ আর স্থানীয় বাবু-সাহেবদের বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারেনি।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের সূত্র মতে, দেশে চা জনগোষ্ঠী প্রায় ৭ লাখ। তার মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিক প্রায় ৯৪ হাজার, অনিয়মিত শ্রমিক আরও ৪০ হাজার। একজন চা শ্রমিকের সাপ্তাহিক বেতন ৭১৪ টাকা। চা বাগানের চা শ্রমিক ব্রিটিশ ঘাটুয়াল বলেন, ৫-৬ সদস্যের অনেক পরিবার আছে যেখানে ১ জন কাজ পাচ্ছে ১০২ টাকা আর বাকিরা এই টাকার উপর নির্ভর করেই দিন চালাচ্ছে। ছোট ভাঙাচোরা ঘরে থাকতে হয় গবাদি পশুসহ সন্তানদের নিয়ে। বাগান কর্তৃপক্ষের ঘর মেরামত করে দেয়ার কথা থাকলেও তা হয় না বছরের পর বছর। তাদের নেই নিজস্ব কোনো জায়গা। বাগানে কাজ না করলে থাকার জায়গাও হারাতে হবে।
সিলেট চা জনগোষ্ঠী ছাত্র যুব কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুজিত বাড়াইক বলেন, ২০১৬ সালের চুক্তি অনুসারে একজন শ্রমিককে অবসর ভাতা হিসেবে সে যতো বছর কাজ করেছে তার মোট বছরের গড়ে দেড় মাসের বেতন হিসেবে পেনশন দেয়ার কথা। কিন্তু তা শুধু কাগজে কলমে। বৃদ্ধ বয়সে পরিবারের বোঝা হয়ে অর্ধাহার-অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মরতে হয় তাদের। কয়েকটি বাগানে নামমাত্র চিকিৎসা সেবা দেয়া হলেও বেশিরভাগ বাগানে সেটি নেই। সবারই নিজস্ব জাতি পরিচয় থাকলেও চা শ্রমিকের সেটি নেই।
এতো বঞ্চনার পরও তারা কেনো প্রতিবাদী হতে পারেন না?- এমন প্রশ্নে চা শ্রমিক ইউনিয়নের মনু ধলাই ভ্যালির সভাপতি ধনা বাউরি বলেন, আমাদের কষ্টের কথা বলে শেষ করা যাবে না। নিজেদের ভালো-মন্দ বুঝে শ্রমিকরা যেনো ঐক্যবদ্ধ হতে না পারেন সেজন্য মালিক পক্ষের পরোক্ষ সহযোগিতায় মদের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করে তাদের মাতাল করে রাখা হচ্ছে।
স্বপ্নকুঁড়ি সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি বিজয় রুদ্র পাল জানান, একজন চা শ্রমিক বাগানে কাজ না করলে তাকে বাগানে থাকতে দেয়া হয় না, অথচ প্রায় প্রতিটি বাগানে নিম্নমানের মদের দোকান আছে যাদেরকে কোনো কাজ ছাড়াই থাকার জন্য জায়গাসহ সব ধরনের সুযোগ করে দিচ্ছে বাগানের মালিক পক্ষ। বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলী বলেন, চা শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য কাজ চলছে। প্রতিটি বাগানে প্রাথমিক স্কুল স্থাপন করা হচ্ছে।