ডেস্ক রিপোর্ট : পবিত্র রমজান শুরু হতে এখনও প্রায় দেড় মাস বাকি থাকলেও ইতিমধ্যেই সারা দেশে খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া রাজধানী ঢাকায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এবং রাজধানীর বাইরে খোঁজখবর নিয়ে এসব পণ্যের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কেন খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপণ্যের এ অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি এবং তা কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনে কষ্টের বোঝা আরও বাড়াবে তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
২৪ মার্চ যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেট এখন আর রমজানের অপেক্ষায় থাকছে না। রমজান শুরুর দুই মাস আগেই পরিকল্পিতভাবে রমজাননির্ভর পণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে এমন অভিযোগ না করা যায়।
বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের বিশেষ তদারকি টিম কাজ করলেও এর সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। উল্টো বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের মূল্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সব ধরনের সবজির দাম এখন আকাশছোঁয়া। কিছু সবজির কেজি ছুঁয়েছে ১০০ টাকা। বাকিগুলোর বেশিরভাগের কেজি ৭০-৮০ টাকা। গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির।
দুই মাস আগে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১২০ টাকা, তা ২৩ মার্চ বিক্রি হয়েছে ১৬৫-১৭৫ টাকায়। বেড়েছে অন্যান্য মুরগির দামও। গত এক মাসে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৭০ টাকা। আর খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭২০-৮০০ টাকায়। সব ধরনের মাছ বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। বেড়েছে খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম।
২৫ মার্চ একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, দিনাজপুরে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। দুই মাস ধরে এ ধারা অব্যাহত থাকলেও গত দুই সপ্তাহে বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ মূল্যবৃদ্ধির জন্য পাইকাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের এবং খুচরা বিক্রেতারা পাইকারদের দায়ী করছেন। তবে বাজার ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম এবং আসন্ন রমজান মাস সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের মজুতদারি বৃদ্ধির কারণেই বেশিরভাগ পণ্যের দাম বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ভোজ্যতেল, বিভিন্ন ধরনের ডাল, গরু, মুরগি, খাসির মাংস এবং বিভিন্ন ধরনের মসলা। ক্রেতাদের দাবি, রমজান মাস এলেই এসব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজির মাধ্যমে এ কাজটি করেন। রাজধানীর বাইরে বিভাগীয় শহরগুলো থেকে প্রকাশিত বেশকিছু স্থানীয় পত্রিকায় খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির খবর এসেছে।
রমজানের আগেই খাদ্যপণ্যের মূল্য যে হারে বাড়তে শুরু করেছে, সে হারে আগামী রমজানেও দাম বাড়ার সম্ভাবনা থাকায় জনমনে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে জনগণ ভয় পায় কেন? এর প্রধান কারণ হল, একটি পরিবারে মাসিক যে ব্যয় হয়, তার কমবেশি অর্ধেক চলে যায় খাদ্যপণ্য সংগ্রহে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০১৬-এর রিপোর্ট মোতাবেক জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৪৭ দশমিক ৭০ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে।
গ্রামাঞ্চলে খাদ্যে ব্যয় হয় ৫০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে খাদ্যে ব্যয়ের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ফলে খাদ্যবহির্ভূত খাতে যেমন- পরিধেয় বস্ত্রাদি, বাড়িভাড়া, আসবাব ও গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদির ব্যয় মেটানো সাধারণ মানুষের পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়ে। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে কমিয়ে আনতে হয় শিক্ষা খাতে ব্যয়, যার শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। সংকুচিত করতে হয় স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়, যা স্বাস্থ্যর জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে রমজান ও নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রমজানের আগে এবং রমজানের শুরুতে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ জিজ্ঞাসা করলে খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষ চাপান বড় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের ঘাড়ে। বড় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা আমদানি করা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করেন আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধিকে। দেশে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির জন্য দোষারোপ করেন পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে। মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে সরকার তার দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।
গতানুগতিক ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এবারও স্থানীয় প্রশাসনকে (বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের) চিঠি দিয়ে বলা হবে, ‘একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অপচেষ্টার’ বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে। তাছাড়া বাণিজ্যমন্ত্রীকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম না বাড়ানোর জন্য তাদের অনুরোধ করতে দেখা যাবে। ব্যবসায়ীরা বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা রাখবেন না। তাই রমজানে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপে নিষ্পেষিত হওয়া যেন এদেশের ভোক্তাদের ভাগ্যের লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মধ্যযুগে ভারতবর্ষের বিখ্যাত সুলতান আলাউদ্দীন খলজি প্রজাদের কল্যাণে কঠোরভাবে নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। ভোক্তারা হয়তো এ যুগেও এমন কাউকে মনে মনে প্রত্যাশা করবেন। প্রায় গোটা ভারতবর্ষের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকারী খলজি বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান আলাউদ্দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৬ খ্রি.) জনগণের কল্যাণে সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, পশু এবং অন্যান্য দ্রব্যের বাজারদর বেঁধে দিয়েছিলেন। ইতিহাসবিদরা লিখেছেন, তার বাজার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি মধ্যযুগের রাষ্ট্রনীতির অঙ্গনে অন্যতম বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল।
এটা ঠিক, আমাদের ম্যাক্রো অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আমাদের জিডিপির আকার বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে এসেছে। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ মাছ ও চাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। এসব ভালো খবরের মধ্যে খারাপ খবর হল ধনী-দরিদ্রের আয় বৈষম্য হ্রাসের বদলে বেড়েই চলেছে।
বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে বিশ্বের দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা কমবেশি ৮০ কোটি। দরিদ্র জনসংখ্যার বসবাসের দিক দিয়ে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ভারত। অর্থাৎ বিশ্বের মোট দরিদ্র জনসংখ্যার কমবেশি ৩৫ শতাংশ ভারতে বাস করে। দরিদ্র জনসংখ্যার বসবাসের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এদের মধ্যে অতি দরিদ্রের সংখ্যা কম-বেশি দেড় কোটি।
এরা অসহায় ও দুস্থ। এদের একটি অংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ওপর নির্ভরশীল। বৃহত্তর অংশটি ক্রয়ক্ষমতার অভাবে বাজার থেকে প্রয়োজনীয় খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। তারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটায়। তারা খাদ্যনিরাপত্তার হুমকির সম্মুখীন। তাই ২০১৮ সালের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৬। আফগানিস্তান ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো হলেও শ্রীলংকা ও নেপালের তুলনায় তা ভালো নয়।
বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতা একটি বড় সমস্যা। ক্রয়ক্ষমতার অভাবে অধিকাংশ মানুষের পক্ষে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এসব পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে শিশু ও মায়েরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির যৌথ উদ্যোগে তৈরি বাংলাদেশ আন্ডারনিউট্রিশন ম্যাপ ২০১৪ অনুযায়ী, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩৯টি জেলায় খর্বাকৃতি শিশু এবং ৫৪টি জেলায় কম ওজনের শিশুর হার ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি। দেশে বর্তমানে ৪১ শতাংশ শিশু খাটো এবং ৩৬ শতাংশ কম ওজনের। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমে এলেও নবজাতকের মৃত্যুর হার এখনও উদ্বেগজনক। নবজাতকের (প্রতি হাজার জীবিত জন্মে) মৃত্যু হার ২৮ জন (সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৮)।
দেশে বর্তমানে খাদ্যপণ্যের উৎপাদক ও ক্রেতার মধ্যে দামের একটা বড় পার্থক্য দেখা যায়। ক্রেতারা, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোর ক্রেতারা ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে জিম্মি। গ্রামে উৎপাদক পর্যায়ে দামে এবং শহরে ক্রেতা পর্যায়ে দামে বিরাট পার্থক্য অনেকদিন ধরে চলে আসছে। বিপণন ব্যবস্থায় সংস্কার ও উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এ অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
তাছাড়া ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া বাণিজ্য ও মূল্যসন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করে বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষার্থে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণীত হলেও দীর্ঘদিন ধরে এটির বাস্তবায়নে জরুরি উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হলেও এটির কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণ অবহিত নয়। সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা খাদ্যপণ্যসহ অনেক পণ্যের মূল্য অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করলেও তা রোধে কমিশন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়নি।
সবশেষে বলতে চাই, খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির যে প্রবণতা সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, সরকার তার লাগাম টেনে ধরুক। রমজানে বহুল ব্যবহৃত খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপণ্যের মূল্য যেন কোনোভাবেই বৃদ্ধি না পায়, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় তা জনগণের, বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলবে।
সূত্র : যুগান্তর।