আরএইচ রফিক,বগুড়া প্রতিনিধি: মেলার নাম পোড়াদহ হলেও এ যেন মাছের মেলা । কি মাছ নাই যে, মিলবেনা এখানে । ২ মন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওজনের বিশাল বিশাল সব ধরনের মাছের সমারহ হয় এখানে । প্রতি বছর বাংলা মাঘ মাসের শেষ বছরে একবার বসে এই মেলা । বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৪ কিঃ মিঃ দুরে পূর্ব বগুড়ার গাবতলী ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ নামক স্থানে মেলাকে কেন্দ্র করে গোটা অঞ্চলে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। বিশেষ এই দিনে সূর্য উদয়ের সাথে সাথে গোটা মেলা এলাকায় নামে মানুষের ঢল। তবে মেলাকে কেন্দ্র করে আগের দিন থেকে গোটা এলাকায় সকল প্রস্তুতি শেষ হতে থাকে ।
কথিত আছে , প্রায় ২’শ বছর আগ থেকে সনাতন ধর্মালম্বীদের সন্ন্যাসী পূজা উপলক্ষে গাবতলী উপজেরার গোলাবাড়ী বন্দরের পূর্বধারে গাড়ীদহ নদীর পশ্চিমপার্শ্বে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে একদিনের জন্য মেলাটি হয়ে আসছে। আদালতের আদেশক্রমে মন্ডল পরিবারের ২২জন জমির মালিকদের যেকোন একজন মেলাটি পরিচালনার জন্য ইজারাদার হিসেবে স্থানীয় মহিষাবান ইউনিয়ন পরিষদ থেকে লাইসেন্স নবায়নের অনুমতি পেয়ে থাকেন। এ লক্ষ্যে মেলাটি সুসম্পন্ন হওয়ার জন্য জোতদাররা প্রতিবছরই বোরো মৌসুমের আগে প্রায় শত বিঘা জমি ফাঁকা রেখে দেন এলাকাবাসী ।
এই মেলাকে উপলক্ষ করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ মেলায় এসে তাদের পসরা বিছিয়ে ক্রয়-বিক্রয় করে। মেলা উপলক্ষে আশপাশের গ্রামের প্রতিটি বাড়ীতে আত্নীয় স্বজন এসে সমবেত হয়। ঈদ বা কোন উৎসবে জামাই-মেয়েসহ অন্যান্য আত্নীয় স্বজনদের দাওয়াত না দিলেও তেমন কোন সমস্যা নেই। তবে মেলা উপলক্ষে দাওয়াত দিতেই হবে, যা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মেলাটি প্রতি বছরের বাংলা সনের মাঘ মাসের শেষ বুধবার অথবা ফাল্গুন মাসের প্রথম কিম্বা শেষ বুধবার অনুষ্ঠিত হলেও কতিপয় স্থানীয় প্রতিনিধিদের খাম খেয়ালিপনায় কখনো কখনো বুধবারের আগে পিছে হয় ।
এলাকায় আরো কথিত আছে প্রায় ২০০ বছর আগে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার গাড়িদহ নদী ঘেঁষে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সন্ন্যাসীরা এখানে আস্তানা গাড়েন। এর প্রায় ৫০ বছর পর স্থানীয় লোকজন এখানে সন্ন্যাসী পূজার পাশাপাশি গোড়াপত্তন করেন ঐতিহ্যবাহী এই মেলার। সেই থেকে প্রতিবছর মেলাটি মাঘ মাসের শেষ বুধবার অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সে হিসেবে গত সপ্তাহের বুধবার এ মেলা শুরু হওয়ার থাকলেও আজ পহেলা ফাল্গুন বুধবার হওয়ায় মেলা হচ্ছে।
প্রতিবারের মত এবারেও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বগুড়ার গাবতলী উপজেলার গোলাবাড়ী বন্দরের পূর্বধারে গাড়ীদহ নদীর পশ্চিমপার্শ্বে ইছামতী নদীর তীরে বুধবার থেকে ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একদিনের আদলে এই মেলা হলেও এলাকার চাহিদা মতে এই মেরা চলে দু’তিন দিন। তবে পর দিন মেলার নাম বদলে হয়ে যায় বৌ-মেলা। ওই দিন শুরু এই মেলায় কেনাকাটা করতে আসেন এলাকার বৌ ঝিরা ।
বুধবার বগুড়া গাবতলীর ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা এক উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যদিয়ে সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হবার খবর পাওয়া গেছে । পোড়াদহ মেলার পরের দিন অর্থাৎ আজ মহা ধুমধামের মধ্যদিয়ে গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়নের রানীরপাড়া গ্রামে অনুষ্ঠিত হবে বউমেলা।
জানা গেছে, প্রতিবছরের মতো এবারো দেশের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে থেকে আসা লাখো মানুষের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল বগুড়া বগুড়া উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা। সিরাজগঞ্জের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদ যমুনা নদীর বিশাল আকৃতির বেশ কয়েকটি বাঘাইড় মাছ মেলায় নিয়ে এসেছিলেন। তার মধ্যে ৮০কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছটি বিক্রি করেছেন ৯০হাজার টাকায়। মাছ ব্যবসায়ী সুরমান আলী যমুনা নদীর ৬৫ কেজি ওজনের একটি বাঘাইড় মাছ মেলায় নিয়ে এসেছেন। তিনিও এক হাজার থেকে ১২’শ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে মাছটি বিক্রি করেছেন। আদমদীঘির আঃ হান্নান ব্যাপারীর মাছের দোকান থেকে সারিয়াকান্দির শফিকুল ইসলাম ১৫কেজি ওজনের একটি বোয়াল কিনেছেন ২২হাজার টাকায়।
ক্রেতা জাহিদুল ইসলাম বলেন, মেলায় মাছের দাম একটু বেশী বেশীই মনে হচ্ছে। মেলায় আসা (জামাই) সোহাগ একটি বড় ব্রিগেড মাছ ক্রয় করেছেন। তিনি জানান, পছন্দের মাছ হওয়ায় দামটা একটু বেশীই নিয়েছে। ৮থেকে ১০কেজি ওজনের কাতলা মাছ ১২ ’শ টাকা কেজি দরে, ১০ কেজির উপরে আইড় মাছ ১২ ’শ থেকে ১৫’শ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। রুই বিক্রি হচ্ছে ৬’শ টাকা কেজি, চিতল ৪’শ টাকা কেজি, পাঙ্গাস ৩’শ টাকা কেজি, ব্রিগেড ৩’শ ৫০টাকা কেজি, ১০কেজি ওজনের উপরে সিলভার কাপ ৪’শ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য জাতের মাছও মেলায় উঠেছে।
মাছ ও মিষ্টির জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠা এই মেলায় ১০কেজি ওজনের মাছ আকৃতির মিষ্টি তৈরী করেছেন বিশিষ্ট মিষ্টি ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ। মহিষাবান এলাকার ব্যবসায়ী লতিফের দোকানে এ মিষ্টির দাম হাকানো হয়েছে ৪ হাজার টাকা। এছাড়া ১ কেজি, ২ কেজি, ৩ কেজি, ৪ কেজি ওজনের মিষ্টিও মেলায় পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন দামে। লতিফের মিষ্টির দোকানে ২’শ মনের বেশী মিষ্টি রয়েছে- যা তিনি মেলার দিনেই বিক্রির জন্য তৈরী করেছেন। গাবতলীর দূর্গাহাটা হাইস্কুল মাঠ, দাঁড়াইল বাজার, বাইগুনি হাটসহ বিভিন্ন বাজারে বাজারে মাছ-মিষ্টির মেলা বসেছিল। উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ী বন্দর সংলগ্ন পোড়াদহ নামক স্থানে প্রায় ৪’শ বছর পূর্বে থেকে স্থানীয় সন্ন্যাাসী পূজা উপলক্ষে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও স্থান পরিবর্তন করে গোলাবাড়ী বন্দরের পূর্বধারে সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানা জমিতে একদিনের জন্য মেলা বসে।
এ ব্যাপারে মেলার পরিচালক স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলাকে ঘিরে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। মেলায় মেয়ে-জামাই, আত্মীয় স্বজনসহ লাখো মানুষের পদচারণা মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা এলাকা। মেলায় শিশুদের জন্য বিনোদনমূলক বিচিত্র গান, নাগোরদোলা, চরকি এবং মটরসাইকেল খেলা ছিল।
গাবতলী মডেল থানার ওসি মোঃ সেলিম হোসেন বলেন, পোড়াদহ মেলাটি সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেলা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে প্রতিবছরের মতো আজ গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়নের রানীরপাড়া গ্রামে অনুষ্ঠিত হবে বউমেলা।