ডা. আবদুন নূর তুষার : এসএসসি, এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করার পর দেশের সবচেয়ে কঠিন একটি ভর্তি পরীক্ষা পার হয়ে তাকে শুরু করতে হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের পড়াশোনা। এমবিবিএস হতে তাকে পাঁচ বছর জীবনপণ করে পড়তে হয়। প্রতি সপ্তাহে পরীক্ষা দিয়ে, কঠিন পেশাগত পরীক্ষা দিয়ে সে ডাক্তার হবার পর ইন্টার্ন করে একবছর। এর মধ্যে এফসিপিএস বা এমডি করলে তার আরো লম্বা সংগ্রাম। তারপর বেসরকারি খাতে তার সর্বোচ্চ বেতন পনেরো থেকে বিশ হাজার। আর সরকারি বেতন তেইশ হাজার একশো যোগ বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য। মোট বড়জোর বত্রিশ হাজার টাকা। টাকাটা অনেক মনে হচ্ছে?
ঢাকা শহরে একজন চিকিৎসক বাড়ি ভাড়া পাবেন মূল বেতনের ৫৫ শতাংশ, অন্য সিটি কর্পোরেশনে ৪৫ শতাংশ আর বাকি সব শহরে ৪০ শতাংশ। সর্বোচ্চ নয় হাজার ছয়শো টাকা। ঢাকা শহরে মেসে থাকা যায় এই টাকায়। একজনেরই জায়গা নেই, স্বামী বা স্ত্রী, সন্তানসহ, ডাক্তার কোথায় থাকবেন এই টাকা দিয়ে? আর বেসরকারি খাতে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, কিছুই নেই। নেই বোনাস। একটা নিয়োগপত্রও অনেক ক্লিনিক দেয় না।
ডাক্তারদের ভিজিট বা ব্যক্তিগত সম্মানী ধার্য করে দিচ্ছেন সরকার। প্রাইভেট প্র্যাকটিস সবার সমান হয় না। এটা অনেকটা গানের শিল্পীদের মতো। সবাই গান গায় কিন্তু সবার জনপ্রিয়তা ও সম্মানী এক নয়। কোনো ডাক্তার যদি অতিরিক্ত পয়সা চান, রোগীরা তার সম্মানীর চাপ নিতে না পারলে তার প্র্যাকটিস কমবে। তার চাহিদা কমে যাবে। এটা সরকারিভাবে ধার্য করলে, সকল ব্যক্তিগত পেশাগত কাজের মূল্যও ঠিক করে দেয়া উচিত। যেমন গানের শিল্পী মমতাজ আপা বা রুনা লায়লা কতো টাকা নেবেন বা একজন উকিল, ব্যারিস্টার রফিকুল হক বা কামাল হোসেন কতো নেবেন বা একজন স্থপতি খালিদ মাহমুদ পলাশ বা ইকবাল হাবিব কতো নেবেন- সেটাও বলে দেয়া দরকার। এটা ঠিক হবে না, কারণ তাদের মতো মানুষ খুব বেশি নেই, তারা ইউনিক, একমে বা দ্বিতীয়ম।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ডাক্তারদের চাকরি, বেতন, সুবিধা বা দাবিদাওয়া নিয়ে গত ২০ বছর ডাক্তারদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বিএমএ কী করেছে, তার বিবরণ লিখতে বললে ডাক্তাররাই লজ্জা পাবেন। আরো লজ্জা হলো, ভিআইপি রোগী হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলার সময় জনৈক অধ্যাপক তার বুকে স্টেথো দিয়ে হৃদযন্ত্রের শব্দ শুনছেন, এমন ছবি ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। চিকিৎসাবিদ্যার প্রাথমিক জ্ঞান আছে এমন লোকেরাও জানেন, রোগী কথা বলবে আর ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করবে বারান্দায়, এটা অমার্জনীয়। এটা চিকিৎসাবিদ্যার অপমান। যারা নিজেরা নিজেদের সম্মানের জন্য লড়েন না, তাদের জন্য অন্যরা লড়বে কেন? সম্মানই বা দেবে কে? চিকিৎসকের সম্মান তলানিতে ঠেকেছে, এবার পাত্র ফুটা হয়ে শূন্য হবার বাকি।
লেখক : কলামিস্ট ও জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক। সূত্র : ডাক্তার প্রতিদিন