সাদিয়া নাসরীন : পুরুষতন্ত্রকে কেবল পুরুষের কার্যকলাপ ও প্রতিক্রিয়া দিয়ে ডিফাইন করা যায় না। বরং পুরুষতন্ত্রকে নার্চার করে এমন সব প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি, বিশ্বাস প্রথা এবং সংস্কৃতিই বর্তমান আছে যার পরিচালক শুধু পুরুষ নয়, বরং বৃহদাকারেই নারী।
পিতৃতন্ত্র আমাদের কনভিন্স করতে পেরেছে যে, পুরুষাধিপত্যের এসব প্রতিষ্ঠান, বিশ্বাস, প্রথা, ধারণা এবং চর্চাগুলো সব সময় এভাবেই ছিলো, এভাবেই আছে এবং এসবের কোনো বিকল্প নেই এবং এগুলো কখনো পরিবর্তিত হবে না। নারী পুরুষ নির্বিশেষেই এই বার্তাকে বহন করেছে এবং পিতৃতন্ত্রের এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করাকে প্রতিরোধ করেছে।
পুরুষতন্ত্রের প্রথম সুবিধাভোগী হিসেবে পুরুষ তার প্রয়োজনে পুরুষাধিপত্যমূলক প্রতিষ্ঠান, বিশ্বাস, প্রথা, বিশ্বাস এবং চর্চার মাধ্যমে গড়ে তুলেছে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতা যার সব কেন্দ্রেই নিজের অবস্থান প্রধান করেছে পুরুষ। পুরুষাধিপত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য পুরুষ ব্যবহার করেছে পরিবার, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্রের মতো প্রতিষ্ঠান, সৃষ্টি করেছে ধর্মগ্রন্থ, ধর্মাবতার, দর্শন, সাহিত্য এবং শাস্ত্র যেখানে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের ভিত্তি প্রোত্থিত।
নারীকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবার ভয় থেকে সবার আগে নারীকে দখল করেছে, নারীর মনস্তত্ত্বকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, নারীর শরীরকে সম্পূর্ণ বন্দী করেছে। ক্রমেই এই পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার প্রথম শোষকশ্রেণি হয়ে ওঠে পুরুষ। তৈরি করা প্রাইভেট ও পাবলিক ডোমেইন এর ক্ষেত্র যেখানে পুরুষ হয়েছে মুখ্য, নারী গৌণ। লিঙ্গ রাজনীতির সুচতুর পরিসর ছড়িয়ে দিয়ে পুরুষকে প্রথম লিঙ্গ এবং নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
যে ধারণা বা বিশ্বাসগুলো লিঙ্গ রাজনীতিকে চিরস্থায়ী করেছে তার মধ্যে প্রথম এবং প্রাথমিক প্রচার হলো, ‘ছেলেরা ছেলে হবে’। এই ধারণা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলতে থাকা সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক বর্ণনাগুলোর একটি যা পুরুষকে সমস্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের বিরুদ্ধে গিয়ে জৈবিকভাবে নির্দিষ্ট কিছু আচরণ করার জন্য, ‘প্রোগ্রামড’ করে দেয়।
পুরুষতন্ত্রের এই সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং ব্যবহারিক ধারণা ও আচরণ পুরুষের স্বাভাবিক মানবিক বিকাশকে খ-িত করেছে, যেখানে একটি ছেলেকে শৈশব থেকে শেখানো হয় কোমলতা পুরুষকে মানায় না, চোখের জলে পৌরুষ থাকে না, ভয়-দুর্বলতা-আপোস পুরুষের জন্য নয়। পুরুষতন্ত্র নির্ধারণ করেছে পুরুষকেই সবসময় উপার্জন করতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে, রক্ষা করতে হবে, জয়ী হতে হবে।
এই ব্যবস্থা পুরুষকে, অনেক সময় নারীকেও ‘ম্যাচোগিরি’ বা ‘মর্দামি’ স্বভাব উদযাপন করতে উৎসাহিত করে, আগ্রাসী পুরুষদের প্রশংসার চোখে দেখে, কোনো পুরুষ আগ্রাসী না হলে তাকে ‘মেয়েলি’ বলে নিপিড়ন করা হয়; উগ্র ছেলেরা শান্ত স্বাভাবের ছেলেদের নির্যাতন করে, যৌন হয়রানি করে। যার ফলে বেশিরভাগ নারী পুরুষই পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসন এবং লৈঙ্গিক সহিংসতাকে চ্যালেঞ্জ করার বদলে নীরব থাকতে, উপেক্ষা করতে এবং ‘পুরুষালী’ আচরণগুলোকে রক্ষা করতে বাধ্য হয়।
আবার যুগের পর যুগ ধরে এই পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসন ও আচরণকে নিরাপদে চলমান রাখার জন্য এর প্রাথমিক মুখপাত্র হিসেবে তৈরি করেছে একদল সুবিধাভোগী নারী গোষ্ঠী, যারা নিজেদের ওপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যকে সমীহ করে এবং টিকিয়ে রাখে। রোজগার-উৎপাদন থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসিত হয়ে গৃহকর্ম, মাতৃত্ব আর যৌনতার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করা এই নারীদের মানসিক গঠন এমন করে ফিক্সড হয়ে যায় যে, তারা স্বনির্ভর নারীদের ‘বেচারা’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং আর ভাত-কাপড়ের জন্য বাবা-স্বামী-ছেলের ওপর নির্ভর করে নিজেদের সুখী নারী হিসেবে ব্রান্ডিং করে।
পুরুষতন্ত্র যে শুধু নারীকেই নিপীড়ন করেনি, পুরুষকেও শৃঙ্খলিত ও শোষিত করেছে প্রতিক্ষেত্রে এই সত্যকে স্বীকার করতে না পারার কারণেই পুরুষরা নিজস্ব ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতা হারিয়ে ‘পৌরুষের দাসে’ পরিণত হয়।
অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক নারীরাও পুরুষের ফাঁদ পাতা সুবিধার বিনিময়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীর বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকেন, পুরুষের ভাষায় কথা বলেন। এই উভয় গোষ্ঠীই শেষ পর্যন্ত পুরুষের স্বার্থরক্ষা করেন এবং পুরুষতন্ত্রের ভিত্তি পাকা করেন। ফেসবুক থেকে