শিরোনাম

প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮, ০৪:৪২ সকাল
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮, ০৪:৪২ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

১৬ ডিসেম্বর : সেই দিন এবং এই দিন

বিভুরঞ্জন সরকার: আজ ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবস। আজ মনে পড়ছে ১৯৭১ সালের এই দিনের কথা । ১৯৭১ সালে আমি দিনাজপুর সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছাত্র ইউনিয়ের সক্রিয় কর্মী। ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। রাস্তায় বেরিয়ে আসে। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো, ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো ইত্যাদি স্লোগান ধ্বনিত হয় মানুষের মুখে মুখে । শুধু ঢাকা নয় , প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও বেরিয়ে আসে পথে।

সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করতে থাকায় পরিস্থিতি এমনিতেই ছিলো অগ্নিগর্ভ। ১ মার্চ সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে ইয়াহিয়া খান আগুকে ঘি ঢালেন। বিক্ষুব্ধ বাঙালিকে আর শান্ত করা যায়নি। মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখ পাকিস্তানি বাহিনী রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতির ওপর। শুরু হয় যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ। যুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সাত মার্চ তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে বলেছিলেন। নিরস্ত্র বাঙালি জাতি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের মুখে যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে যোদ্ধায় পরিণত হয়েছিলো। তারপর নয় মাস জুড়ে বাঙালি জাতি আনন্দ-বেদনার এক মহাকাব্য রচনা করেছিলো। নভেম্বরের শেষ দিকেই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো যে পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় সময়ের ব্যাপারমাত্র। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রবল হচ্ছিলো। চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে তাদের নাস্তানাবুদ অবস্থা। তারা ঘাঁটি রক্ষা করতে পারছিলো না। পিছু হটছিলো। মুক্তাঞ্চলের পরিমাণ বাড়ছিলো।

বেসামাল পাকিস্তান ডিসেম্বরের তিন তারিখ ভারত আক্রমণের মধ্য দিয়ে চরম ভুলটি করে বসে। তখনই বাংলাদেশে তাদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। ডিসেম্বরের এক তারিখ থেকেই পাকিস্তানিদের পরাজয়ের ক্ষণ গণনা শুরু হয়। জেলা শহরগহলো মুক্তি ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর দখলে আসতে থাকে। চূড়ান্ত পরাজয়-পর্ব কীভাবে হবে তা নিয়ে যখন মানুষের মধ্যে আলোচনা, জল্পনাকল্পনা, তখন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল সাম মানেক'শ বেতারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশে একটি বাণী প্রচার করেন। এটা লিফলেট আকারে ছেপে বিমান থেকে ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। এর মূল কথা ছিলো, তোমরা ( পাকিস্তানি সেনারা) চারদিক থেকে অবরুদ্ধ আছো। কাজেই অস্ত্রসমর্পণ করো। ( হাতিয়ার ঢাল দো, হামারা বাহিনী চারি তরফসে তুমকো ঘিরলিয়া)। কোনোভাবেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয় বুঝতে পেরে অবশেষে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশে দখলদার পাকি জেনারেল নিয়াজী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল নিয়াজী। নব্বই হাজারের বেশি সৈন্য নিয়ে তারা মাথা নত করে পরাজয় স্বীকার করে নেয়। গর্বে মাথা উঁচু হয় বিজয়ী বাঙালি জাতির। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র বাস্তব রূপ পায়। রক্ত-অশ্রু-কষ্ট-যন্ত্রণার বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়। সত্যি 'দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়'।

আমরা বিজয়ী হয়েছি। পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদর্শন এবং তার সমর্থকদের পরাজিত করেই বাঙালি বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো। কিন্তু একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর কী সব বাঙালি আনন্দে উদ্বেল হয়েছিলো? দেশ শত্রু মুক্ত হওয়ায় সব বাঙালি কী বিজয় আনন্দে মেতেছিলো? না, সেদিন কেউ কেউ বিষণ্ণ হয়েছিলেন। পাকিস্তান ভাঙার মনোবেদনায় তারা মুহ্যমান হয়েছিলেন। আমরা অনেকে যখন আনন্দে দিশেহারা, তখন পরাজিতরা মনে কষ্ট চেপে কষছিলো নতুন পরিকল্পনা। প্রতিশোধ পরিকল্পনা।

সেদিন যদি ওরা পরাজিত না হয়ে আমরা পরাজিত হতাম তাহলে কি হতো? বিজয়ের ৪৭ বছর পরে এসে এই জিজ্ঞাসাটাই আজ বড় হয়ে সামনে আসছে।

যারা পরাজিত হয়েছিলো তাদের একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিলো। তারা ছিলো গণবিরোধী, শোষক, ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক এবং স্বৈরাচারী। আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম এসব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই। আমাদের যুদ্ধ ছিলো স্বাধীনতা, মুক্তির। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পরাজয়ে আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলো। কিন্তু মুক্তি কি পেলাম? ৪৭ বছরে আমরা এগিয়েছি অনেক। আবার সামনে চ্যালেঞ্জও কম নেই। সব থেকে বড় বিপদের কথা হলো, পরাজিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদর্শনে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা দেশে বাড়ছে। ধর্ম আর যার যার বিশ্বাসের বিষয় না থেকে রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠছে। যেসব ক্ষত থেকে মুক্তির জন্য জীবন ও সম্ভ্রম দিয়েছি, সে ক্ষতই আবার বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। পরাজিতের দর্শনই যদি আমরা গ্রহণ কিংবা অনুসরণ করি তাহলে বিজয়ের গর্ব করার কোনো অধিকার আমাদের থাকে কি?

আমাদের আবেগ-উচ্ছ্বাস সবই দিবসকেন্দ্রিক। বিজয় দিবসেও আমরা উচ্ছ্বাস করবো, নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করবো কিন্তু বিজয়ের মধ্য দিয়ে যা অর্জন করতে চেয়েছি তা কি অর্জন ও রক্ষা করতে পারছি?
আমরা গালভরা বুলি কপচাই। বলি - আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত, এ রক্ত পরাভব মানে না।
কিন্তু জাতির পতাকা পুরানা শকুন খাবলে ধরলেও আমরা থাকি নির্বিকার।

শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ। আর আমাদের চলছে নানা মতে, নানা পথের দলাদলি। ওরা দিচ্ছে কূটকচাল। আমরা করছি কূটতর্ক। একাত্তরে যারা এক সঙ্গে ছিলাম এখন তারা একসঙ্গে নেই। পরাজিতরা জেতার জন্য ক্রমাগত কৌশল বদল করে আমাদের ঘায়েল করছে। দৃশ্যপট পাল্টাতে হবে। এবারের বিজয় দিবস কি আমাদের ভ্রান্তিমোচনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে? মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়বো ঠিক আছে কিন্তু শত্রুর সঙ্গে গলাগলি আর কতো? ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে কী আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিজয় নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ?

মুক্তির মন্দির সোপানতলে যারা জীবনদান করেছেন, বিজয় দিবসে তাাদের কথা স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায়। জয় বাংলা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়