ডঃ শোয়েব সাঈদ : অভিমানী অরিত্রী অপমানটা নিতে পারেনি। সর্বনাশা প্রতিক্রিয়ায় জীবনের সমস্ত চাওয়া-পাওয়া, পাস-ফেলের জাগতিক অনুভূতিগুলোর সীমানা পেরিয়ে চলে গেল চিরতরে। “সন্তান” আশরাফুল মকলুকাত মানুষ থেকে চারপাশের পশু-পাখী সকল প্রাণীকুলের সবচেয়ে প্রিয় আর নিঃস্বার্থে নিবেদিত এক অনুভূতির নাম। মানুষ, সেই দিনমজুর থেকে বিলিয়নিয়ার, সবাই একটি কামনায় সহজাত ঐক্যবদ্ধতায় আবদ্ধ আর সেটি হচ্ছে “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে”।
বায়োলজির অলঙ্ঘনীয় ম্যাপিং এ “আমার সন্তান” কেন্দ্রীক সিগনেলগুলো অন্যের সন্তানদের চাইতে আবেগ, সহানুভূতি, আশ্রয়, প্রশ্রয় আর ভালবাসায় বেশ পার্থক্য সৃষ্টি করে বৈকি। এটি মানবিক সীমাবদ্ধতা, অপরাধ নয়। কিন্তু যিনি শিক্ষক হবেন তাঁর এই মানবিক সীমাবদ্ধতাটুকু নিয়ন্ত্রণ করার প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। সমসাময়িক সভ্যতার জটিল জীবনযাত্রায় এই প্রশিক্ষণ খুব বেসিক। হেড স্যারের/আপার কঠিন চেহারার আড়ালে একটি কোমল হৃদয় কিংবা মফস্বল শহরের সেলিব্রেটি শিক্ষক সেই হেড স্যার/আপা সহ অন্য শিক্ষকদের ছাত্র-ছাত্রীর পরিবার পর্যন্ত জানা-শুনার সংস্কৃতিটির সেই যুগটি এখন আর নেই। প্রবল প্রতিযোগিতার এই যুগে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের সেই মাধুর্যের বদলে যান্ত্রিকতাই এখন নিয়ন্ত্রক। আর্থিক আর রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির বিশাল এক সিন্ডিকেটের রাহুর গ্রাসে বাংলাদেশের অনেক নামকরা স্কুল, স্কুল পরিচালনা কমিটি। ফলে হৃদয় নির্ভর দায়িত্ববোধ থেকে অভিভাবকত্বের দায়দায়িত্ব পালনের চাইতে অহমিকা আর দম্ভ নির্ভর চালচলনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন শিক্ষকদের অনেকেই।
প্রতিযোগিতার এ সমাজে অভিভাবকরাও ছুটছেন সীমাহীন প্রতিযোগিতায় সন্তানদের ফিট রাখবার জন্যে। মেধায় ফিট রাখতে গিয়ে বহু সন্তান আনফিট হয়ে যাচ্ছে শারীরিক, মানসিক আর মানবিক স্বাস্থ্যে। ক্ষতিটা মাঝে মধ্যে ষোলআনাই বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন অভিমানী অরিত্রীরা মায়ার সব বন্ধন ছিন্ন করে সীমাহীন প্রতিযোগিতা থেকে চিরতরে প্রত্যাহারে হৃদয়বিদারক এপিসোডে।
পরীক্ষায় নকল করা যে কোন দেশে, যে কোন সভ্যতায় অপরাধ এবং অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু স্কুলতো শুধু পড়ালেখা বা বিদ্যা অর্জনের জায়গা নয়, মানুষ গড়ারও কারখানা, অন্যায়/ভুল ইত্যাদি শোধরানোর জায়গাও বটে। একটিমাত্র অপরাধের জন্যে একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে সংশোধনের সুযোগ না দিয়ে বাবা-মাকে তলব করে প্রকাশ্য অপমান করে সরাসরি স্কুল থেকে বের করে দেবার হুমকির ঘটনা চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি। এটি আমাদের সমাজে দীর্ঘ মেয়াদে লালন করা ক্ষমতার অপব্যবহারের নিকৃষ্ট নমুনা। এটি নির্দয়তা আর অমানবিকতার প্রতিচ্ছবিও বটে। এই শিক্ষকরা কি নিজেদের জীবনে, তাঁদের সন্তানদের জীবনে বিশুদ্ধতায় ১০০%? ন্যায়-অন্যায়ের ছোট-খাট কোন ঘটনা কি নেই উনাদের জীবনে? অরিত্রী যদি কোন প্রভাবশালী বা স্কুল কমিটির কারো মেয়ে হতেন, কর্তৃপক্ষ কি একই রকম আচরণ করতেন? এই খড়গহস্ততা কি শিক্ষার বাজারজাতকরণের অনিবার্য পরিণতি?
মেয়েটির হয়তো পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল কিন্তু এই ঘাটতিটুকু জীবনের বিশাল ক্যানভাসের ছোট একটি ক্ষণমাত্র। নকলের অভিযোগ যদি সত্য হয় তবে বুঝা যায় পরীক্ষার প্রস্তুতির ঘাটতিজনিত বাস্তবতাকে সহজভাবে গ্রহণ না করে যেকোনভাবে ভাল ফলের বেপরোয়া মনোভাব ছিল। এই ধরণের ঘটনা না ঘটার জন্যে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকদেরও দায়-দায়িত্ব থাকে। নর্থ আমেরিকার স্কুলে এই ঘটনা ঘটলে প্রথমেই অভিভাবকদের ডাকবে না। শিক্ষক নিজেই বিষয়টির ফয়সালা করবেন কারণ উনিতো শিক্ষক; মূল্যবোধ শিখানো তাঁরই যে দায়িত্ব। শিক্ষকের চেষ্টায় সংশোধন না হলে অভিভাবককে রিপোর্ট করবেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ অরিত্রীর অভিভাবকদের সাথে যেভাবে ডিল করেছেন পুরো বিষয়টি ছিল গাড়ল সংস্কৃতি। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের রুচিবোধ প্রশ্নবিদ্ধ। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীকে নিয়ে এরকম নির্মম কঠোরতা আমাদের সমাজের সার্বিক অসহিষ্ণুতাকেই নির্দেশ করে।
পড়াশুনা নিয়ে বাচ্চাদের উপর অত্যাধিক চাপ ভারতীয় উপমহাদেশে রীতিমত একটি উপদ্রবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে এই চিত্রটি ভয়াবহ। এমনকি বিদেশেও ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আগত অভিবাসীদের মধ্যে এই বিপদজনক প্রবণতা প্রবল। অভিভাবকদের এই আচরণে “দুধে-ভাতে” রাখার বাচ্চাটির জীবনকে দুর্বিষহ করে দিচ্ছে। সাধ আর সাধ্যের চেক এন্ড ব্যালেন্সের অভাবে বাচ্চাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিপদটা হরেক রকমের। যে সমস্ত বাচ্চারা পড়াশুনা নিয়ে ক্রমাগত চাপে থাকে, দুশ্চিন্তা তাদের নিত্য সাথী। ডিপ্রেসন আর নানাবিধ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হবার ঝুঁকি প্রবল। গবেষণায় প্রমাণিত অভিভাবকদের চাপ আর আত্মহত্যা চিন্তায় যোগসূত্র আছে। স্টাডি বলছে অভিভাবকদের কাছ থেকে ভাল গ্রেডের চাপে প্রতি পাঁচজনের একজনের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা বাড়ায়। ভাল ফলের প্রত্যাশাজনিত মাত্রাতিরিক্ত চাপ ব্যক্তিত্ব আর আত্মমর্যাদা গঠনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। জন্মগতভাবে যে মেধাবী তাঁর পক্ষে যা ধারণ করা সম্ভব, কম মেধাবীর ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়, ফলে বাড়তি চাপে হিতে বিপরীত হতে পারে।
একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ এবং স্টাডি বলছে মাত্রাতিরিক্ত চাপ অনৈতিকতাকে উৎসাহিত করে। জ্ঞান অর্জনের চেয়ে পরীক্ষায় ভাল ফল যেখানে সামাজিক স্বীকৃতির নিয়ামক, সেখানে বাচ্চাদের মধ্যে চিট/প্রতারণা বা অবৈধ/অনৈতিক কাজের প্রতি আসক্তি বাড়ায়। প্রথম হবার পেছনে যে ছুটে, যে কোন ছোট খাট ব্যর্থতায় তাঁর মধ্যে সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবার মানসিকতা কাজ করবে। এধরণের মাইন্ড সেটআপে বাচ্চাদের বড় করা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ।
যে সমস্ত অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তাঁদের অনেকেই পশ্চিমা বিশ্বে সন্তানদের পড়াশুনার কথা ভাবেন। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে বাচ্চারা বিশ্বের যে কোন দেশের চেয়ে পড়াশুনা নিয়ে কম চাপে থাকেন। এক গবেষণায় দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ৬৪ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন বাচ্চাদের পড়াশুনার ব্যাপারে অভিভাবকদের বাচ্চাদের আরেকটু চাপ দেওয়া ভাল। চীন আর ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রে এই অভিমত বিপরীত কারণে এখানে বাচ্চারা পড়াশুনার জন্যে প্রচণ্ড চাপে থাকেন। “তৃতীয় বিশ্ব মানসিকতা” নামে পরিচিত এই চাপ আখেরে যে ভাল নয়, বহুদেশ তা বুঝতে পারছে এবং সেই দেশগুলোর শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে সমস্যার মোকাবেলা করছেন।
আমরা অরিত্রীদের মত সাত রাজার ধনদের বুকে আগলিয়ে রাখতে চাই দুধে-ভাতে, আর কোন অভিমানী অরিত্রী অপমানের গ্লানিতে যেন আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে না পারে তার জন্যে সিস্টেমটা/আমাদের মানবিকতা/শাসন করার যোগ্যতায় বড় ধরণের পরিবর্তনটা এখনি জরুরী।
আপনার মতামত লিখুন :