রাশিদ রিয়াজ : প্রতিটি মুসলমানকে আইন মেনে চলতে হবে যে দেশে সে বাস করে সেই রাষ্ট্রের। কোনো দেশের শাসন ব্যবস্থায় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ নিশ্চিত হয় তারই নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে যারা সংসদে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন। তাই নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। বরং এ এক আমানত যার সম্পর্কে কোনো মুসলমান যদি সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারে, সঠিক প্রার্থীকে ভোট না দেয় তাহলে আমানত খেয়ানতের পর্যায়ে পড়তে পারে।
কোনো দেশে যদি মুসলিমরা সংখ্যালঘু হয় তাও নির্বাচনে অংশ নেয়া বা ভোট দেয়া সমানভাবে জরুরি। শত শত বছর ধরে আলেম ওলামারা নির্বাচনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে বলে আসছেন কারণ ইসলামের শুরুতে মুসলিমরা সংখ্যালঘুই ছিল। তবে ‘ল অব দি ল্যান্ড’ বা কোনো দেশের আইনের শাসনের মানে গণতন্ত্রে কিছুটা ভিন্ন আবহ দেয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের জন্যে যে আইন তা কিন্তু খ্রিস্টান কোনো রাজা বা শাসক করে দেননি। তা হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। যাতে মুসলমানদের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি রয়েছে। তা মজার কিছু প্রশ্নেরও উত্থাপন করে। কারণ ‘ল অব দি ল্যান্ড’ এর ভেতরে থেকে কিভাবে একজন মুসলিম ভোটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে!
কারণ, মুসলিম হওয়ার কারণে তাকে শরিয়াহ মেনে চলতে হয়। তো কেউ কেউ মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের উচিত শরিয়াহ আইনকে বরং দেশটির ‘ল অব ল্যান্ডে’র অংশ করে নিতে প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন। এবং একারণেই বা এধরনের প্রচেষ্টা সম্পর্কে যে ভয় দেখা যায় তা বরং শরীয়ার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে উৎসাহের সৃষ্টি করে।
তাহলে শরিয়াহ কি কোনো দেশের আইনের সঙ্গে অংশীদার হয়ে উঠে পরবর্তীতে প্রভাব বলয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করে? মদ খাওয়া নিষিদ্ধ বা জুম্মার নামাজ বাধ্যতামূলক করতে উদ্যোগী হয়? এর উত্তর না কিন্তু তা কেন? খোদার পথ বলতে কোরআন ও হাদিসের নির্দেশিত পথ বুঝায়। এবং তা অনুসরণ করা মুসলমানদের জন্যেই কেবল বাধ্যতামূলক। মুসলমানদের জীবন কিভাবে পরিচালিত হবে, কিভাবে সে নামাজ পড়বে, কি খাবে, কি পান করবে, কিভাবে সে বিয়ে করবে, সে মারা গেলে তার ধন সম্পদের বন্টন কিভাবে হবে এসব আইন হচ্ছে ফিকাহ যার অর্থ হচ্ছে বোঝাপড়া। আর আলেমরা কিন্তু খোদার পক্ষে কথা বলছেন এমনটি বলেন না, বলেন খোদার ইচ্ছায় আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভাল ও সফল অনুসরণ কি হতে পারে। এজন্যে ফিকাহ সম্পর্কে বিভিন্ন মতপার্থক্যের সৃষ্টি হতে পারে।
কিন্তু ফিকাহ বিশাল এক ক্যানভাসের একটি অংশ। ফিকাহ’র বাইরে সিয়াসা বা রাজনৈতিক প্রশাসন ইসলামে কি হতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এই সিয়াসা তৈরি করেন শাসকরা, আলেমরা নন। শাসকরা ধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন বা এর ওপর ভিত্তি না করে জনগণের ভালমন্দ বা মাসয়ালা’কে প্রাধান্য দেন। সিয়াসা বলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে। ট্রাফিক আইন, পরিবেশ রক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে সিয়াসা দিক নির্দেশনা দেয় সমসাময়িক ইস্যুর ওপর নির্ভর করে, ধর্মীয় গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে নয়।
তাহলে শরিয়াহ কি ভোটের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে। করে কারণ- মুসলমানকে এটুকু চিন্তা করতেই হয় যাকে সে ভোট দেবে সে কি জনগণের সার্বিক কল্যাণ বিবেচনা করে কি না। প্রার্থী কি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে যার কারণে সে নির্বাচিত হলে একজন মুসলিম হিসেবে জীবনযাপনে কোনো অন্তরায় সৃষ্টি হবে না। মুসলমান যখন ভোট দেবে তখন তা কি এমন কোনো প্রার্থীকে দেবে যে এজন্যে তার ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে আপোষ করতে হবে? কারণ সামাজিক যে বিধিবিধান হালে বা ভবিষ্যতে হতে যাচ্ছে তার অনেক কিছুই সে ফিকাহ’তে নাও পেতে পারে। এটি তার মেধা, মগজ ও প্রজ্ঞা থেকে নির্ধারণ করে যা প্রার্থীর সঙ্গে যায় কি না তা বিবেচনা করাও জরুরি। কোরআন ও সুন্নাহ পরিবেশের যত্ন নিতে বলে, গরীবদের সাহায্য করতে বলে, বৈষম্য দূর করতে বলে, ন্যূনতম বেতন কত হলে কেউ অন্যায় পথে পা না বাড়িয়ে জীবন যাপন করতে পারে, কিভাবে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হতে পারে ইত্যাদি। তাই মুসলমানকে চিন্তা করতে হয় তার নির্বাচিত প্রার্থী ভবিষ্যতে এমন উন্নয়ন করবে কি না বা করেছেন কি না যা একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীর মানুষের জন্যেই এবং গণমানুষ তা থেকে বঞ্চিত হবার ফলে আকাশ সমান অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো বাড়তে পারে। যে কারণে জাকাত ব্যবস্থাপনাই বিফলে চলে যেতে পারে।
নির্বাচনী প্রার্থী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ কিভাবে বিবেচনা করেন, শ্রমের মর্যাদা দেয়ার ক্ষেত্রে তার অতীত ভূমিকা, বেসরকারি খাত প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিদেশি বাজারের সঙ্গে টিকে থাকতে তার গৃহীত পদক্ষেপগুলো কি ছিল এধরনের ইত্যাকার বিষয়গুলো বিবেচনা জরুরি। অর্থাৎ পরিবারের ইচ্ছে, সমাজের অমুক ব্যক্তি বা পছন্দসই কোনো প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়ার আব্দার রক্ষা কোনো মুসলমানকে তার নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে দুরে সরিয়ে দিলে আমানত খেয়ানতের প্রশ্ন এসে যেতে পারে। একজন মুসলমান শুধু তার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে ভোট না দিয়ে তাকে বরং গণমানুষের স্বার্থ রক্ষার দিকটি বিবেচনা করতেই হয়। কারণ ফিকাহ তার মুসলিম আচরণকে দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। (আগামি পর্বে সমাপ্য)