তুরিন আফরোজ : আজ ৪ নভেম্বর। আমাদের সংবিধান দিবস। এই দিনটিতেই আমরা, বাংলাদেশের মানুষ, নিজেদের জন্য একটা সংবিধান প্রণয়ন ও গ্রহণ করতে পেরেছিলাম।
নিঃসন্দেহে এটা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য একটা বিশেষ ও ঐতিহাসিক দিন। সংবিধান হলো নাগরিক হিসেবে আমাদের সঙ্গে রাষ্ট্র তথা বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি। এই দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের সংবিধান, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার ফসল। এদিন আরো মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের কি এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সংবিধান দিবস আরো মনে করিয়ে দেয় যে এদেশের মানুষ সংবিধান ও তাঁর মহত্বকে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
সংবিধানের ৭(২) ধারায় উল্লেখ আছে যে আমাদের সংবিধান "জনগণের একাম্ত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ"। তবে এই জনগণ কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল জনতা ছিলো না, বরং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত ও সুবোধ ছিলো। বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় জনতা যে স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছিলো তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সংবিধান রচনাতেও বঙ্গবন্ধুই ছিলেন জনতার দার্শনিক ও আধ্যাত্বিক নেতা। স্বাধীনতার মাত্র ৩২৪ দিনের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করে বিশ্বকে বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছিলো তাঁর মুক্তির লড়াই কতটা যৌক্তিক ছিলো।
সংবিধান দিবস পালন দেশের মানুষকে রাষ্ট্রের মূলনীতিগুলো মেনে চলতে উৎসাহ যোগায়। যেহেতু, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দিনটি একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও জনগণকে স্ব স্ব অধিকার ও কর্তব্য মনে করিয়ে দেয়।
একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবগুলো সাংবিধানিক লক্ষ্য শতভাগ অর্জন করার প্রত্যাশা উচ্চাভিলাষী। তবুও জাতিকে তাঁর সাংবিধানিক লক্ষ্য পূরণে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হয়। অতীতে বাংলাদেশকে তাঁর সংবিধানের মূলনীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। অনেক সময় সংবিধানকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে, স্থগিত রাখা হয়েছে, এমনকি ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলার হুমকিও দেয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মত মহৎ প্রক্রিয়ার মধ্যে জন্ম বলেই আমাদের সংবিধানের শুরুতেই সেই চারটি মূলনীতির উল্লেখ আছে যেগুলোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে জনতা ১৯৭১ সালে প্রাণ দিয়েছিলো। অতীতে ক্ষমতালোভী শাসকেরা নিজেদের সুবিধামত সংবিধানকে বারবার অপমান করেছে। সে সময় এমনকি আমাদের বিচার বিভাগও সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা করার সাহস পায়নি, চাকরি যাবার ভয়ে। দুটো সামরিক সরকারের কোনটাই সংবিধানকে সম্মান দেখানোর প্রয়োজনবোধ করেনি। কারণ তাদের দরকার হয়ে পড়েছিলো নিজেদের অবৈধ ক্ষমতা দখলকে নির্লজ্জভাবে ন্যায্য প্রমাণ করা। সে সময় দেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য সংবিধানের চার মূলনীতি থেকে বঞ্চিত ছিলো। ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র ফিরে আসার পরে ধীরে ধীরে সংবিধানের চার মূলনীতিও ফিরে আসে।
কিন্তু সম্প্রতি রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের অন্যতম- বিচার বিভাগ, সংবিধানের সমান সার্বভৌমত্ব দাবী করে বসায় একটা নতুন হুমকি দেখা দেয়। সংবিধান অনুযায়ী, বিচার বিভাগ একটি স্বাধীন সত্ত্বা, কিন্তু তা সর্বোচ্চ বা সার্বভৌম নয়। তাই, যদি বিচার বিভাগ বেআইনীভাবে, সংবিধানের উচ্চতাকে অস্বীকার করে সর্বোচ্চ স্থানের দাবী করে, তাহলে সমাজ নিশ্চিতভাবেই 'সংঘাতময় সংবিধানতন্ত্র' (chaotic constitutionalism) এর শিকার হবে। আমাদের জাতীয় জীবনে যার কোন স্থান নেই। প্রত্যাশা আর বাস্তবতার মধ্যেকার ফারাক কমানোর দায়িত্ব শুধু নীতিনির্ধারকদের নয়, রাষ্ট্রের সব কটি অঙ্গ- সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগেরও।
সর্বোপরি, দেশের প্রতিটা নাগরিকের দায়িত্ব আছে প্রত্যাশার কাছাকাছি আচরণ করার। যাতে আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলতে পারি বহুকাঙ্খিত "সোনার বাংলা"।
আপনার মতামত লিখুন :