শিরোনাম
◈ পাকিস্তানি অভিনেত্রী হুমাইরার ময়নাতদন্তে ভয়ঙ্কর সব তথ্য ◈ অর্থের বিনিময়ে ৬ বছরের শিশুকে বিয়ে: তালেবান প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আপাতত রক্ষা! ◈ আবারও মে‌সির জোড়া গোলে ইন্টার মায়ামির জয় ◈ এখন থেকে আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নাম থাকবে না: জ্বালানি উপদেষ্টা ◈ ‘তুমি কেন ফুয়েল কেটে দিলে?’ ভারতীয় বিমান বিধ্বস্তের আগে পাইলটদের শেষ ককপিট ভয়েস রেকর্ডিং ◈ দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসীদের জন্য সুখবর: মৃত্যু হলে লাশ দেশে পাঠাবে সরকার, ক্ষতিপূরণ মিলবে বীমার আওতায় (ভিডিও) ◈ বিশ্বের সর্বাধিক মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হতে যাচ্ছে ভারত: পিউ রিসার্চ ◈ বেপরোয়া বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ছয় মাসে নিহত ৪৩ ◈ স্প‌্যা‌নিশ ক্যাবরেরাই থাক‌ছেন বাংলা‌দেশ ফুটবল দ‌লের কোচ ◈ সন্ধ‌্যায় নেপালের বিরু‌দ্ধে লড়াই‌য়ে নাম‌ছে বাংলা‌দে‌শের মে‌য়েরা

প্রকাশিত : ০৪ নভেম্বর, ২০১৮, ০৩:২৭ রাত
আপডেট : ০৪ নভেম্বর, ২০১৮, ০৩:২৭ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অর্জুনের সঙ্গে দেখা, হিউস্টনে

লুৎফর রহমান রিটন : টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টন আমার মেয়ের শহর। সময়-সুযোগ পেলেই হুট-হাট চলে যাই হিউস্টনে, মেয়ের কাছে। কন্যা নদী ওর বর ডেভিড আর আদুরে বেড়াল কিটক্যাটকে নিয়ে সংসার পেতেছে এই শহরের রোজেনবার্গে।

১৯৫৩ সালে আমেরিকায় বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত জুলিয়াস ও এথেল রোজেনবার্গ দম্পতিকে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে মৃত্যুদ-ের মাধ্যমে হত্যা করেছিলো তখনকার মার্কিন সরকার। রোজেনবার্গ দম্পতির এই মৃত্যুদ- ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছিলো বিখ্যাত লেখক কৃষণ চন্দরকে। তিনি ‘পাপ’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন রোজেনবার্গ দম্পতি স্মরণে। কারাগারে থাকা অবস্থায় জুলিয়াস ও এথেল দম্পতি চিঠি লিখতেন পরস্পরকে। রোজেনবার্গ দম্পতির চিঠিগুলো পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে বাংলায় ‘রোজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ’ নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে ক্যালকাটা বুক ক্লাব লিমিটেড থেকে।

আমার কন্যা নদীদের নিবাসস্থল রোজেনবার্গ এলাকাটির নামের সঙ্গে রোজেনবার্গ দম্পতির কোনো যোগসূত্র আছে কী না জানি না।

০২ অক্টোবরের ৭ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত কাটিয়ে এলাম রোজেনবার্গে। এর আগেও একাধিকবার গিয়েছি সেখানে। কিন্তু এবারের রোজেনবার্গ বা হিউস্টন ভ্রমণটা ছিলো অন্য সব বারের চেয়ে একেবারেই আলাদা। একুশের শহিদ মিনার এবং রবি ঠাকুরের ভাস্কর্য দেখা হলো এবারেই। দুর্গা বাড়িতে গিয়ে দেখা হলো ঢাকেরবাদ্যিযোগে পূজা অর্চনাও। এবং এই প্রথমবারের মতো হিউস্টনের আলোকিত তরুণ প্রজন্ম ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলাপ ও পরিচয়ের সুযোগ ঘটলো আমার। এবং সেটা আনুষ্ঠানিক ভাবেই।

সুযোগটি তৈরি করে দিলো সুদীপ্ত সরকার, তারেক মোহাম্মদ, সৈয়দ মনোয়ার ওরফে রেশাদ, শাহেনশাহ্ এবং তাদের বন্ধুরা। এরা প্রত্যেকেই মেধাবী প্রকৌশলী। প্রকৌশলী হলেও এরা প্রত্যেকেই শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী। এবং প্রত্যেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় শানিত, প্রবলভাবে। প্রথমজন সুদীপ্ত, বিতার্কিক ছিলো বাংলাদেশে। ডিবেট ফেডারেশনের অন্যতম কর্তা ছিলো। দ্বিতীয়জন তারেক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো। নাট্যপরিচালক ও অভিনেতা হিশেবে সম্ভ্রম অর্জন করেছে হিউস্টনে। আবৃত্তিকার হিসেবেও। তৃতীয়জন সৈয়দ মনোয়ার,একটা বই লিখেছে প্রবাসী নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী কিশোর-তরুণদের কাছে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিতে—ইবধঁঃরভঁষ ইধহমষধফবংয রহ নৎরবভ নামে। চতুর্থজন শাহেনশাহ্, বুয়েটে এক সময় শিবিরকে দাবড়ানির ওপর রাখতো বলে কথিত আছে।

১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় সুদীপ্ত এবং ওর বন্ধুরা স্থানীয় মহারাজা রেস্টুরেন্টের হলরুমে আমাকে নিয়ে একটি আলাপচারিতা ধরণের অনুষ্ঠান করবে বলে পরিকল্পনা করেছিলো।

সুদীপ্তই নিয়ে গেলো আমাকে। ওখানে গিয়ে দেখি আমার একটা ছবিসহ বেশ বড়সড় একটা ব্যানার ঝুলিয়ে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। শুভ্র-শাদায় উদ্ভাসিত মঞ্চ। এক পাশে আমার জন্যে আলাদা একটা টেবিল- চেয়ার ও মাইক্রোফোন। অন্য পাশে দুই সঞ্চালকের আসনে তারেক ও রেশাদ।

উপস্থাপক তারেক ও রেশাদ আমাকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে উঠে গেলো কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই। তারপর তারেক নিজের লেখা একটা ছড়ার মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। ওর ছড়া প্রয়াসটা ছিলো এরকম—-

 

‘’সুজন সজ্জন আর মননে সৃজন

আসনে আসীন এই লুৎফর রিটন।

নায়াগ্রার জলের রং কালো হতো যদি

শীতকালে মাঝপথে জমে যেত নদী

রিটনের তেমনি জোড়াগোঁফের নীচে

হাসি যেন সর্বদা আলো হয়ে নাচে।

পন্ডিতি সরু তাঁর চশমার নীচে

জ্বলন্ত চোখ সদা ওঁৎ পেতে পিছে

হাস্য, রহস্য মায়া হেনো কিছু নাই

ভিতরে বাইরে সব দেখে নেয়া চাই।

দেখে নেয়া দেখাগুলো দেবে কি রেহাই?

খাওয়া দাওয়ার বাড়া তাই আছে এক খাই—

বেঁচে থাকার প্রেরণায় ছড়া লেখা চাই

ছড়াই জীবন ছড়াই মরণ রিটনের তাই

লাড্ডু জিলিপি খেয়ে মন্ডা মিঠাই

এক্ষুনি লিখে বলে কিছু লিখিনাই।’

 

এই কারণেই আমাকে আসনে আসীন করেই অনুষ্ঠানের সূচনা। অতঃপর দুই সঞ্চালকের প্রশ্নমালা আমার উদ্দেশ্যে একের পর এক। বিরামহীন। লেখালেখি, বিটিভিতে আমার অনুষ্ঠানসমূহ, উপস্থাপনা, ছোটদের ধারাবাহিক দু’টি নাটক ঝন্টু-পন্টু এবং হইচই, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, আমাদের সঙ্গীত ভুবন, আমার ছেলেবেলা, ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক জীবন, বিবাহ, পরিবার থেকে বিতাড়িত হওয়া, আমার সম্পাদিত ছোটদের পত্রিকা, ছোটদের ছড়া, বড়দের ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা, একাত্তরের ঘাতক দালাল, রাজাকার আলবদর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আমার দেশান্তরি হওয়ার প্রেক্ষাপট ইত্যাদি নানান বিষয়ে চললো আমাদের কথোপকথন। সে এক এলাহী কা-! কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে চললো আবৃত্তি ও গান। আবৃত্তিতে অংশ নিলেন হাফিজ, আহাদ, জাহিদ, মারুফ, তন্দ্রা, অলি, আকাশলীনা ও দীঘল। গান গাইলেন নাহিদ এবং শম্পা। ছোট্ট বন্ধু আকাশলীনা আবৃত্তি করলো আমার ছড়া ‘মাকে নিয়ে’। দীঘল করলো ‘ভূঁত ছড়াকার’। ভীষণ আনন্দ পেয়েছি আমি প্রবাসে ইংরেজি স্কুলে পড়া দুই ছোট্ট বন্ধুর বাংলায় আবৃত্তি শুনে।

অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে দীঘল ওর বাবা মায়ের সঙ্গে আমার কাছে এসেছিলো কথা বলতে। ওর মায়ের আগ্রহে আমার সঙ্গে ছবি তুলতে। ছবি তুলতে ওর পাশে দাঁড়াচ্ছি যখন, তখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি প্রভাস আমিন নামে কাউকে চেনেন? আমি বললাম, চিনি তো! শুধু আমি কেনো, বাংলাদেশের সবাই চেনে। বিখ্যাত সাংবাদিক। টিভিতে দেখা যায়।

খুব খুশি খুশি চেহারায় দীঘল বললো, তিনি আমার বাপী হন।

মানে কী! প্রভাস তোমার বাপী! তুমি প্রভাসের মেয়ে! আরে! তুমি এইখানে কী করো এই হিউস্টনে!

ওর মা আর বাবা জানালেন, প্রভাস মামাকে সে বাপীই বলে। খুবই আদরের ভাগ্নী সে প্রভাস আমিনের।

আমি বললাম, তোমার বিখ্যাত বাপী আমারও ফেসবুক বন্ধু। আসো তোমার সঙ্গে ছবি তুলি। তোমার সঙ্গে আমার ছবি দেখলে সে আমাকে গুরুত্ব না দিয়ে যাবে কোথায়!

শুনে কী যে খুশি হলো মেয়েটা!

সিরিয়ার ছোট্ট আইলানকে নিয়ে নিজের লেখা মর্মস্পর্শী একটা কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন জাহিদ। এবং ট্রাম্পকে নিয়ে স্বরচিত ছড়া পড়েছিলেন মারুফ। উপস্থিত দর্শক- শ্রোতারা মুগ্ধ হয়েছেন তাঁদের আবৃত্তি শুনে। নাহিদ যখন গাইছিলেন ‘ কে গো অন্তরতর সে/ কত আনন্দে জাগায় ছন্দ কত সুখে দুখে হরষে’...তখন চমৎকার একটি আবহ তৈরি হয়েছিলো শুভ্র-সফেদ স্নিগ্ধ মঞ্চে।

এই অনুষ্ঠানেও আমি ব্যাখ্যা করে বলেছি কেনো আমি গান লিখতে আগ্রহী নই। কেনো আমি গীতিকার হতে চাই না। সম্ভবত গীতিকার হিসেবে আমাকে প্রতিশ্রুতিশীল বিবেচনা করেই শম্পা গাইলেন আমার লেখা শুভ্র দেবের গাওয়া ‘তিরিশ লক্ষ প্রাণের দামে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গানটি। দেখলাম উপস্থিত দর্শক- শ্রোতারাও জানেন গানটা। শুভ্রর কল্যাণে ভালোই সুনাম হলো।

এই অনুষ্ঠানেই পরিচয় হলো এস এস নেওয়াজ নামের এক প্রবীনের সঙ্গে। পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে একজন বললেন, নেওয়াজ ভাই হচ্ছেন হিউস্টনের কলম্বাস। অর্থাৎ কী না তিনি হচ্ছেন হিউস্টনের প্রথম দিককার বাঙালি অভিবাসী। স্বাধীনতার আগে থেকেই হিউস্টনে আছেন। ছাত্র হিসেবে এসেছিলেন। তিনি তাঁর লেখা বই—’ নোনা জলের পদ্মদিঘি’ আমাকে উপহার দিলেন। বইটা বেরিয়েছে কলকাতা থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হিউস্টন ইউনিভার্সিটিতে প্রবাসী পাকিস্তানি ছাত্র সংসদের(পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি) কর্মকা- একটি অধ্যায়ে তুলে ধরেছেন এস এস নেওয়াজ। একাত্তরে প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকাও লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। ইতিহাসের উপাদান হিশেবে যার গুরুত্ব অনেক।

আমি আমার তুমুল যৌবনের সোনালি দিনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় কাটিয়েছি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গুরু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অপরূপ সান্নিধ্যে। সায়ীদ স্যারের ছাত্ররা বিশেষ করে কেন্দ্রের এককালের খুদে প-িতরা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। আমার সঙ্গেও ওদের দেখা হয়ে যায়। এবার হিউস্টনে আমাকে নিয়ে একটি সন্ধ্যার আয়োজনের খবর পেয়ে চার ঘন্টা ড্রাইভ করে ডালাস থেকে চলে এসেছিলো সিতু। মুনশি আনিসুল ইসলাম সিতু। কাঁচাপাকা চুলের সিতু নামের যুবকটিকে চিনতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিলো। আমার কথা ও আচরণে সিতু হেসে উঠলে ওর হাসিমাখা মুখের মধ্যে ওর কৈশোরের ছবিটা ভেসে উঠেছিলো আর তক্ষুণি আমি শনাক্ত করে ফেলেছিলাম সিতুকে। অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের ক্লাসফ্রেন্ড গল্পের মতো করে। কুড়ি বাইশ বছর পরে দেখা হলো ওর সঙ্গে। সিতু গড়গড় করে ওর ব্যাচের কচি আঁতেলদের নাম বলছিলো। যে তালিকায় বিখ্যাত গোলাম মোর্তুজা থেকে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মোহন, বিপ্লব মোস্তাফিজ থেকে জয়-রোমেল-লায়লা- মোখলেস-এপোলোসহ আরো অনেকেই ছিলো। মাত্র কয়েক ঘন্টার দেখাদেখির জন্যে আট ঘন্টার ড্রাইভকে(আসা+যাওয়া) পাত্তা না দিয়ে ছুটে আসা সিতুকে কঠিন একটা আলিঙ্গনে না বাঁধলে কি চলে! এর নাম ভালোবাসা। এই ভালোবাসা অমূল্য। টাকা দিয়ে কেনা যায় না।

ফেসবুকে প্রকাশিত আমার সাম্প্রতিক ছড়ানাট্য ‘আত্মহত্যার পূর্বরাত্রি’ থেকে অংশ বিশেষ পাঠ করলো তন্দ্রা চক্রবর্তী। পৃথিবীর মানুষেরাই এর পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস করছে এটাই ছিলো ছড়ানাট্যের প্রতিপাদ্য। রচনাটা আমি উৎসর্গ করেছিলাম নিসর্গপ্রেমী অমৃতের সন্তান আমার প্রিয় মানুষ দ্বিজেন শর্মাকে। তন্দ্রা এমন আন্তরিক উচ্চারণে অকৃত্রিম মমতার সঙ্গে আবৃত্তি করছিলো যে মঞ্চে আমার পাশে স্বয়ং দ্বিজেন শর্মাকে আমি অনুভব করছিলাম। সম্পর্কের দিক থেকে দ্বিজেন শর্মা হচ্ছেন তন্দ্রার কাকু।

‘আমি অর্জুন’ নামের আমার ছড়াটা আবৃত্তি করলেন অলি মোহাম্মদ। হিউস্টন শহিদ মিনার কমিটির সভাপতি তিনি। অনুষ্ঠানে আসার খানিকক্ষণ আগে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো আমার, শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে। তখনই বুঝেছিলাম অনন্য সাধারণ এক দেশপ্রেমিক এই মানুষটি। অলি মোহাম্মদ ‘আমি অর্জুন’ ছড়াটা এমনই আবেগ মথিত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন যে হল ভর্তি দর্শক শ্রোতারা পিন পতন নিরবতায় তাঁর পাঠ শুনলেন। অনেকের চোখের কোণেই তখন চিকচিক করছে অশ্রুকণা। পাঠ শেষে অশ্রু মুছে নিলেন আবৃত্তিকার নিজেও।

ছড়ায় বর্ণিত দৃশ্যকল্পে মায়ের গর্ভে থাকা এক ভ্রুণ শিশুসন্তানের কথামালা ছিলো। অনাগত সন্তানের জন্যে অপেক্ষমান তরুণ বাবা মায়ের নানা ঘটনা ছিলো। সন্তান মেয়ে হলে কী নাম হবে, ছেলে হলে কী নাম হবে সেটাও নির্ধারিত ছিলো। সিদ্ধান্ত নেয়াই ছিলো যে সন্তান মেয়ে হলে ওর নাম হবে দ্যুতি আর ছেলে হলে নাম হবে অর্জুন। পৃথিবীতে গমন প্রতীক্ষায় মায়ের পেটে অপেক্ষমান অর্জুন ওর বাবা মায়ের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের ভালোবাসা বিনিময় প্রত্যক্ষ করে সীমাহীন মুগ্ধতা নিয়ে। এমন সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে চলে যান বাবা। মাকে একলা একা ফেলে। পেটে ক্রমশঃ বড় হওয়া সন্তানকে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের হাত থেকে নিজে বাঁচতে এবং সন্তানকে বাঁচাতে সেই তরুণী মা এই গ্রাম থেকে সেই গ্রামে ছুটে বেড়াচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। দেশ স্বাধীন হয়। সবাই ফিরে আসে। ফেরে না শুধু অর্জুনের বাবাটা। স্বাধীন দেশে অর্জুনের জন্ম হয় এক বুক অভিমান নিয়ে। কতো কথা জমিয়ে রেখেছিলো সে, বাবাকে বলবে বলে! অর্জুন বিশ্বাস করে ওর বাবার বুকের রক্ত লেগে আছে বলেই বাংলাদেশের পতাকার গোলাকার সূর্যটা ওরকম টকটকে লাল। অর্জুন বিশ্বাস করে ওর বিধবা মায়ের শাদা শাড়ির আঁচলে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস লেখা রয়েছে।

ছড়ার বিষয়বস্তু এবং অলি মোহাম্মদের আকুল করা পাঠে এমন কিছু ছিলো যা হলভর্তি দর্শককে বিমোহিত ও অশ্রুসজল করেছিলো।

অনুষ্ঠান শেষে অনেকেই হাসিমুখে এগিয়ে এলেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। ছবি তুলতে। প্রচুর ছবি তোলা হচ্ছে। নানান বয়েসী মানুষের ভালোবাসায় প্লাবিত হতে হতে একজন লেখকের অনন্য প্রাপ্তিকে উপলব্ধি করছিলাম হৃদয় দিয়ে। এমন সময় লাল শার্ট পরা এক যুবক এসে হাত মেলালো—আমি আপনার অর্জুন।

—মানে? আমার অর্জুন মানে?

—আপনার লেখায় যে অর্জুনের কথা বলেছেন আমি সেই অর্জুন। একাত্তরে আমি আমার মায়ের পেটে ছিলাম। বাবাকে দেখিনি। আমার জন্মের আগেই আমার বাবাকে হত্যা করেছিলো রাজাকার মতিউর রহমান নিজামী। আমার জন্ম হয়েছে স্বাধীনতার পরে, মার্চে। আমিও বাবাকে দেখিনি। আপনার সঙ্গে আমার কোনোদিন দেখাও হয়নি। কী করে লিখলেন আমার গল্পটা!

যুবকের কথা শুনে আমার সমস্ত শরীরে কী রকম একটা শিহরণ বয়ে গেলো। প্রবল আবেগে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। আমার বুকের সঙ্গে ওর বুকের ধুকপুকানি বিনিময় হচ্ছে। ছেলেটা বলে যাচ্ছে ওর জীবনের করুণ গল্পটা। ওর বাবার নাম ছিলো কসিমুদ্দিন। কসিমুদ্দিন হত্যা মামলাতেই ফাঁসি হয়েছে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর।

হিউস্টনে বসবাস করা আমার অর্জুনের নাম জুলফিকার।

কিছুক্ষণ পর ঝলমলে শাড়ি পরা ঝকমকে হাস্যোজ্জ্বল এক তরুণী এগিয়ে এলো আমার কাছে—রিটন ভাই, আমি অর্জুনের বউ......

আমার আশীর্বাদের হাতটা আপনিতেই উঠে গেলো তরুণীর মাথায় আমার অর্জুনকে দেখে রেখো ভাই।

সম্পাদনা: ফাহিম আহমাদ বিজয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়