ফরিদুন্নাহার লাইলী : স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টি দিন চিরকাল কলঙ্কিত দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, তার একটি তিন নভেম্বর। বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে ৩৯ বছর আগে ১৯৭৫ সালের তিন নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অসীম সাহসিকতায় নেতৃত্ব দেন তারা। গঠন করেন মুজিবনগর সরকার। জাতীয় এই চার নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় দেশের মানুষ। ঘরে ঘরে তৈরি হয় দুর্গ, পাল্টা আঘাত হানে শত্রুর উপর। নয় মাস যুদ্ধের পর স্বাধীনতা পায় বাংলাদেশ।
একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা ব্যাপক ধ্বংস এবং হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দেশ জুড়ে। এরপর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ধানমন্ডির বাসভবন থেকে। গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ইপিআর এর একটি ছোট ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। পাকিস্তানি সামরিকজান্তা ভেবেছিলো বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার পরে আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু না, জাতির সেই ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরার জন্য এগিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী এবং সহযোগী বন্ধুরা। মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব হাতে তুলে নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান। জাতীয় এই চার নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় দেশের মানুষ। নয় মাস যুদ্ধের পর স্বাধীনতা পায় বাংলাদেশ। তখন যদি এই চার নেতা শক্ত হাতে লাগাম না ধরতেন তবে আমাদের সেদিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন হয়তো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতো। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মম গণহত্যা, অত্যাচার, নিপীড়নের চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে বিশ্বজনমতের সমর্থন, প্রতিবেশি ভারতে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আশ্রয় সুনিশ্চিত করা, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণের জন্য ভারতকে রাজি করানো, শেষ পর্যন্ত ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহায়তায় দেশ স্বাধীন করার মতো দুরূহ কাজ তাঁরা সম্পাদন করেন অত্যন্ত সুষ্ঠু এবং সফলভাবে।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয়েছিল। পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু-পাল্টা ক্যুর রক্তাক্ত অধ্যায়ে মানবতার শত্রু ও বঙ্গবন্ধুর হন্তারক ওই একই পরাজিত শক্তির দোসর বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা সেদিন দেশমাতৃকার সেরা সন্তান এই জাতীয় চার নেতাকে শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কাপুরুষের মতো গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয় খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে একাত্তরে পরাজয়ের জ্বালা মিটিয়ে ছিলো। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিলো একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। আসলে হত্যাকারীরা এবং তাদের দোসররা চেয়েছিল পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশটিকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে নিক্ষেপ করতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুনর্গঠন ও গণতান্ত্রিকতার পথ থেকে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে বিচ্যুত করা এবং বাংলাদেশের মধ্যে থেকে একটি মিনি পাকিস্তান সৃষ্টি করা। এখানেই শেষ হয়নি স্বাধীনতার শত্রুদের ষড়যন্ত্র। পঁচাত্তরের পর থেকে বছরের পর বছর বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা চলে।
একাত্তরের পরাজিত শক্তি এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে সত্যি কিন্তু রেখে গিয়েছে তাদের রক্তবীজের ঝাড়। তারা আজ পর্যন্ত বিষাক্তসাপের মতো সময়-সুযোগ মতো ছোবল দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সুদক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে সেই অপশক্তিকে নির্মূলের মাধ্যমে দেশকে মায়ের মতো আগলে রেখেছেন।
লেখক : কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য।