আবুল কাসেম ফজলুল হক : নির্বাচন সামনে নিয়ে বাংলাদেশ এখন কেবল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত। নির্বাচন উপলক্ষে সব দলের জন্য সমান সুযোগ, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনÑ এসব কথা ওয়াশিংটন, লন্ডন, প্যারিস থেকে ঢাকা পর্যন্ত সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। যেসব সমস্যার কথা দেশে-বিদেশে বছরের পর বছর ধরে বলা হচ্ছে, সেগুলোর সমাধান চাই।
তবে এই নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতির উন্নত প্রক্রিয়া সূচিত হবেÑ এমনটি আশা করা যায় না। জনজীবন যেমন চলছে, তেমনি চলবেÑ বদলে যাবে না। উন্নত অবস্থা সৃষ্টির জন্য প্রস্তুতি লাগে। চিন্তা-চেতনার উন্নতি লাগে। নৈতিক সচেতনতা ও শৃঙ্খলা দরকার হয়। মানুষ ভালো কাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। তাকে শিখতে হয়। রাজনীতিতে এই শিক্ষা অর্জিত হয় মূলত রাজনৈতিক দলের ভেতরে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা হয়তো গোটা পৃথিবীতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর উন্নত রাজনৈতিক চরিত্র অর্জনের কোনো অনুশীলনই তো নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক চরিত্রের উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। রাজনীতিতে সক্রিয় বুদ্ধিজীবীদের আচরণ দেখে লোকে তাদের ‘দলদাস’ বলে অভিহিত করেন। বুদ্ধিজীবীরা কেবল দলদাসই নন; তাদের মধ্যে যারা বিশিষ্ট, তারা সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন গঠন করে বিশিষ্ট নাগরিকরূপে সক্রিয় আছেন। বিশিষ্ট নাগরিকদের অবস্থান বুদ্ধিজীবীদের ওপর। লোকে তাদের বৃহৎ শক্তিবর্গের লেজুর বা দালাল বলে থাকেন। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দ্বারা রাজনীতির উন্নতির আশা কী করে করা যাবে।
চৌদ্দ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত নানা বাধা-বিপত্তি, চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে আঁকাবাঁকা পথ ধরে ইতালি থেকে উদ্ভূত রেনেসাঁসের স্পিরিট দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল এবং প্রাধান্য বিস্তার করে চলছিল। কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলায়ও ঘটেছিল রেনেসাঁস। বিশ শতকের প্রথমার্ধে একে একে দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। রেনেসাঁসের স্পিরিটকে পরাজিত করে সম্পত্তিলিপ্সু, কায়েমি-স্বার্থবাদী যুদ্ধবাজরা কর্তৃত্বে আসে। বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের কাছে এবং সাধারণ মানুষের কাছেও যুদ্ধ প্রতীয়মান হয় সভ্যতার গভীর সংকটের অভিব্যক্তিরূপে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালেই সংঘটিত হয় রুশ-বিপ্লব। সামনে আসে সমাজতন্ত্রের আদর্শ। অনেক রাষ্ট্রে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে গণতন্ত্রের আদর্শও তখন নবায়িত হয়। এসব অবলম্বন করে সভ্যতার সংকট কেটে যাবে এ রকম ধারণা ও আত্মবিশ্বাস তখনো মানবজাতির মধ্যে বজায় থাকে। মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে তখন চলছিল আদর্শগত যুদ্ধ, কোল্ড ওয়ার। কোল্ড ওয়ারের মধ্যেও মানবজাতি আশাবাদী ছিল।
এরই মধ্যে কাউন্টার রেনেসাঁসরূপে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিকতাবাদ সামনে আসে। এসব মতাদর্শের অনুসারীরা নৈরাশ্যবাদী, শূন্যবাদী, নেতিবাদী বক্তব্য প্রচার করতে থাকেন। মানবজাতি বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। এ অবস্থায় ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ ঘটে। মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থাও নষ্ট হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রেরই পতন।
এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ওয়াশিংটনকে পরিণত করে একমাত্র পরাশক্তিতে। বিশ্বব্যবস্থা হয়ে পড়ে এককেন্দ্রিক ও ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক। উদ্ভাবিত হয় বিশ্বায়নের মতবাদ। বিশ্বায়নের কর্তৃপক্ষ আছে : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জি সেভেন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা হলো বিশ্বায়নের কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে ন্যাটো আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও আছে, জাতিসংঘও আছে। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকেই মনে হতো বিশ্বায়ন। এখন মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃত্ব রাখতে পারছে না। মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ, বহুত্ববাদ, উদারতাবাদ ইত্যাদি হলো বিশ্বায়নের মূল নীতি। ইতিহাসের ধারা লক্ষ করলে দেখা যায়, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের ধারায় গড়ে উঠেছে বিশ্বায়নের মতবাদ। বিশ্বায়ন হলো সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর স্তর।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৮০-র দশকে গর্বাচেভ যখন গ্লাসনস্ত (মুক্তনীতি) ও পেরেস্ত্রৈইকা (পুনর্গঠন) জারি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তখনই বুঝে ফেলে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের দিন শেষ হয়ে এসেছে। সমাজতন্ত্রকে তখন থেকে তারা একটি আবেদনহীন মতবাদ মনে করে চলে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার তখন সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র অত্যন্ত বিপজ্জনক আদর্শরূপে সামনে আসবে। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে এর মোকাবিলার জন্য তারা তখন উদার গণতন্ত্র প্রচার করতে থাকেন।
গণতন্ত্রকে তখন তারা নির্বাচনতন্ত্রে পর্যবসিত করেন। তারা তাদের সহযোগীদের নিয়ে কার্যক্ষেত্রে এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন যে, গণতন্ত্র মানে নির্বাচন কিংবা নির্বাচনই গণতন্ত্র। তারা বিকশিত করেন এনজিও, সিএসও পরারষ ংড়পরবঃু ড়ৎমধহরুধঃরড়হ। অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে যে বিশ্বগ্রাসী মতবাদ তারা গ্রহণ করেন, তা অভিহিত হয় নব্য-উদারতাবাদ নামে। নব্য-উদারতাবাদ গণতন্ত্রকে অর্থহীন মতবাদে পরিণত করে। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি রাষ্ট্রে আগ্রাসী যুদ্ধ চালিয়ে ও গণহত্যা চালিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে কথিত উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে! সিরিয়ায় চালানো হয়েছে কথিত উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ।
রাশিয়া সিরিয়ায় সেনা পাঠিয়েছে বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় রাখার জন্য। গণতন্ত্র পরিণত হয়েছে সম্পূর্ণ আবেদনহীন মতবাদে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে কী চলছে? বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। হুজুগ তৈরি করার জন্য নির্বাচনকে ঘোষণা করা হয় জনজীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব বলে। আশির দশক থেকে গণতন্ত্রের নামে চালানো হচ্ছে হুজুগের পর হুজুগ। ১৯৮০-র দশক থেকেই হুজুগ, ভাঁওতা-প্রতারণা ও উসকানি হয়ে আছে বাংলাদেশের রাজনীতির নির্ধারক ব্যাপারে। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভীষণভাবে সক্রিয় আছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
বাস্তবে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরিকল্পনা অনুযায়ী দুনিয়াব্যাপী সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র এখন জনগণের কাছে আবেদনহীন মতবাদ। বাংলাদেশে আশির দশকের শুরু থেকে গণতন্ত্রের নামে জনসাধারণকে যেভাবে হুজুগে মাতানো হতো, সেভাবে হুজুগ তৈরি করাও এখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।
সাম্রাজ্যবাদী মহল বিশ্বায়নকে গণতন্ত্রের নামে গণবিরোধী, কর্মনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য ধর্মকে জাগিয়ে তুলেছে। এর জন্য অবলম্বন করেছে নানা কৌশল। মানবজাতি নিক্ষিপ্ত হয়েছে চরম আদর্শগত শূন্যতায়। এ অবস্থায় দুনিয়াব্যাপী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে জনস্বার্থে পরিবর্তন করতে হবে। দুনিয়াটাকে বদলাতে হবে। তাতে সাম্রাজ্যবাদের এবং দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের দালালদের সঙ্গেই দেখা দেবে মূল বিরোধ। এ বিরোধে জয়ী হতে হলে বিশ্বায়নের বা সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য ও কার্যধারাকে বুঝতে হবে এবং সাম্রাজ্যবাদীদের ও তাদের স্থানীয় দালালদের চিনতে হবে। সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করার কার্যক্রমকে বুঝতে হবে।
বাংলাদেশে ধর্মকে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে একভাবে ব্যবহার করত, বিএনপি অন্যভাবে। এখন আওয়ামী লীগ ধর্মের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, বিএনপি ধর্মীয় শক্তির ওপর তার দখল বজায় রাখতে পারছে না।
মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদ-সৃষ্ট মতবাদ। জঙ্গিবাদ সাম্রাজ্যবাদ-সৃষ্ট মতবাদ। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরিচালনায় মৌলবাদবিরোধী, জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলন করে বা যুদ্ধ করে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের চক্র থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। যে শক্তি সাপ হয়ে কামড়ায় আর ওঝা হয়ে ঝাড়ে, তার দ্বারা কি সাপের কামড়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের চক্র থেকে উদ্ধার লাভ করা যাবে না। মানবজাতির নৈতিক পতন আজ এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে, গণহত্যার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই, যুদ্ধ থামানোর ও বিদেশি সেনাদের বিতাড়নের জন্য কোনো আন্দোলন নেই। আদর্শগত কোনো অনুসন্ধিৎসা নেই।
জঙ্গিবাদীদের চরিত্র স্পষ্ট। জঙ্গিবাদীরা যে হত্যাকা- চালাচ্ছে, বিশ্ববাসী তার বিরোধিতা করে এবং তার অবসান চায়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের চরিত্র কি বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট? বিশ্ববাসী আসলেই কি ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে ন্যাটো বাহিনীর কার্যক্রমের সঙ্গে একাত্ম? আগ্রাসী যুদ্ধ ও গণহত্যা সম্পর্কে নীরব থেকে বিশ্ববাসী কী চায়? এ দ্বারা বিশ্ববাসী কী চরিত্রের পরিচয় দিচ্ছে? এ চরিত্রের পরিণতি কী হবে? মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বাহিনী, ব্রিটিশ বাহিনী, ন্যাটো বাহিনী রেখে কি জঙ্গিবাদ নিঃশেষ করা যাবে?
মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোয় জনগণের মনের অবস্থা কী? তাদের দেশে মার্কিন বাহিনীর, ব্রিটিশ বাহিনীর, ন্যাটো বাহিনীর আগ্রাসী উপস্থিতিতে এবং সামরিক অপারেশনে তারা কি খুশি? আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায়, মিসরে জনগণ কী চায়? আমি জানি না। আমার হাতে এ বিষয়ে তথ্য নেই। তবে ইতিহাসের ধারা লক্ষ করে আমার ধারণা হয় যে, তাদের মধ্যে জাতীয় স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা আছে, তারা বিদেশি সেনাদের উপস্থিতিকে ঘৃণা করে। তাদের দুর্ভাগ্য এই যে, বিদেশি শক্তির উপস্থিতিতে এবং আগ্রাসী যুদ্ধের মধ্যে তারা স্বাধীনতা-সংগ্রামের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারছে না। তাদের চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতি অনেক পিছিয়ে আছে। জনগণের জাতীয়তাবাদী আকাক্সক্ষার সুযোগ নিয়েই তালেবান, আল কায়েদা, আইএস ইত্যাদি জঙ্গিশক্তি গড়ে উঠেছে এবং ইসলামের নামে জঙ্গি অপারেশন চালাচ্ছে। তারা ইসলামের নামে যে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তা ইসলামসম্মত নয়।
ওয়াহাবি মতবাদ যে জিহাদ প্রচার করেছিল, তা তালেবান, আল কায়েদা, আইএসের মতবাদ থেকে ভিন্ন। মাওলানা মওদুদী জিহাদের যে মতবাদ প্রচার করেছিলেন, তাও ভিন্ন। গুপ্তহত্যার মতবাদ তারা কেউই প্রচার করেননি। ইসলামের নামে গুপ্তহত্যার কার্যক্রম কোরআন-হাদিসসম্মত নয়। ওয়াহাবি মতবাদ নিয়ে রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদ ও চব্বিশ পরগনার তিতুমীর সম্মুখসমরে শহীদ হয়েছিলেন। তারা গণআন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। গুপ্তহত্যায় বিশ্বাসী ছিলেন না। গণঅভ্যুত্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। আরব জাতিগুলোর বিশেষ দুর্গতির মধ্যে, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার চরম অন্যায়ের মধ্যে তালেবান, হুজি, আল কায়েদা, আইএস ইত্যাদি জঙ্গিবাদী সংগঠনের উত্থান। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, জীবন দিয়ে এসব করছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুদ্ধ ও গণহত্যা চালিয়ে এদের নিঃশেষ করতে পারবে?
বাংলাদেশে ২০০৪ সালে মার্কসবাদী সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে দমন করার জন্য র্যাব গঠিত হয়। তারা এখন ব্যবহৃত হচ্ছে জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে। এর দ্বারা কি সন্ত্রাসবাদ-মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের সমস্যার সমাধান হবে? আমাদের ধারণা, সাময়িক প্রতিকারের এই প্রচেষ্টা দ্বারা সমস্যা ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হবে। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে পুলিশ, র্যাব, আদালত, জেলখানা, ফাঁসিকাষ্ঠের দরকার আছে; কিন্তু শুধু এসবের দ্বারাই সমস্যার সমাধানের চিন্তা সম্পূর্ণ ভুল। একসঙ্গে বহুমুখী চেষ্টা চালাতে হবে। সেসব নিয়ে ভাসা ভাসা চিন্তা কেউ কেউ করছেন, গভীর চিন্তা ও সর্বমুখী কার্যক্রম দরকার।
১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে সামরিক বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অভ্যুত্থানকে সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছিল।
আফগান জনগণ এই অভ্যুত্থান মেনে নেয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে এ শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য পর্যায়ক্রমে এক লাখের বেশি সেনা পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে ১৯৭৯ সালে ইরানে খামেনির নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ইসলামি বিপ্লব সাধিত হয়। সে অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার ঘাঁটি হারায়। তখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানে তখন কয়েকটি জঙ্গিবাদী গ্রুপ গড়ে উঠেছিল। সেগুলো থেকে তালেবান গ্রুপটিকে বেছে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অর্থ, অস্ত্র, ট্রেনিং ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করে। এ কাজে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। তালেবান বাহিনী বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে গোটা আফগানিস্তানে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে কাবুলে তালেবানরা সরকার প্রতিষ্ঠা করে। তখন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বপরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মৌলবাদের তত্ত্ব দিয়ে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধর্মকে জাগিয়ে তোলার কৌশল অবলম্বন করে।
বিবিসি রেডিও তখন পরিচালনা করে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন। তা দ্বারা সাধারণ মানুষের ধর্মবোধকে আঘাত করা হয়। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দুর্গতির মধ্যে এবং সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার মধ্যে ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটে। পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিবিসি রেডিও মারফত পরিচালনা করে নারীবাদী আন্দোলন। বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের ধারণাকে উৎখাত করে পুরুষতন্ত্র ও নারীর অধস্তনতার ধারণা দিয়ে আন্দোলন চালানো হয়। এতেও সাধারণ মানুষের ধর্মবোধ আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং পুরনো পরাজিত সংস্কার-বিশ্বাস পুনরুজ্জীবিত হয়। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ধ্বংস করা হয়। তখন যুক্তরাষ্ট্র চরম মারমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করে। লোকে বুঝতে পারে, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে। এর মধ্যে সৃষ্টি হয় জঙ্গিবাদের এবং জঙ্গিবাদ পাকিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রসারিত হয়। জেএমবি ও আরও কয়েকটি জঙ্গিবাদী গ্রুপ বাংলাদেশে কর্মতৎপর আছে।
এই বাস্তবতা ও এর ইতিহাস জেনে নতুন রাজনীতি সৃষ্টি করে সমস্যার সমাধান করা ও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম চালাতে হবে। গতানুগতিক রাজনীতি দিয়ে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ নিয়েই অনিশ্চিত নিরাপত্তার মধ্যে চলতে হবে।
আজ দরকার প্রতিটি রাষ্ট্রের ভেতরে আদর্শগত পুনর্গঠনের এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনর্গঠনের আন্দোলন। অন্যদিকে দরকার আন্তর্জাতিক আন্দোলন। দুটিই অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এ ঢাকা শহর থেকেও আরম্ভ হতে পারে এ দ্বিমুখী আন্দোলন। যে ত্রিদলীয় স্বৈরাচারবিরোধী জোটের নেতৃত্বে এরশাদ সরকারকে উৎখাত করা হয়েছিল, তারাই তো ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে নানাভাবে ক্ষমতায় আছে। তিন দলের পরিচালক শক্তি হিসেবে ছিল সিএসও-নাগরিক কমিটি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব সরকারের এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর। সেটা করার জন্য যে নৈতিক মান দরকার তা কি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, সিপিবি, বাসদ প্রভৃতি দলের আছে? জোট গঠনের এবং জোটের মাধ্যমে সমস্যাবলি সমাধানের যে চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, তাতেও সরকার পক্ষের জোট যত শক্তিশালী, সরকারবিরোধী পক্ষের জোট সে তুলনায় দুর্বল। সরকার সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, প্রশাসন ইত্যাদিকে সাফল্যের সঙ্গে অনুগত রাখতে পারছে। সরকারের দমননীতি অত্যন্ত কঠোর। মতপ্রকাশের সুযোগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। আশা করা যায় কি আসন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি উন্নতির দিকে যেতে আরম্ভ করবে?
রাজনীতিতে সততা বৃদ্ধি দরকার। রাজনৈতিক আদর্শের পুনর্গঠন দরকার। বিশ্বব্যবস্থার পুনর্গঠন নিয়েও নতুন চিন্তা দরকার। চিন্তার সঙ্গে কাজ দরকার। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে উন্নত করা যাবেÑ উন্নত করতে হবে।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র : দৈনিক আমাদের সময়