ড মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: দেখা যাচ্ছে বিগত কয়েকটি বছরের তুলনায় এবং মুসক ও আমদানি শুল্কের অগ্রগতির তুলনায় প্রত্যক্ষ কর আয়কর আয়ের প্রবৃদ্ধির মাত্রা কেমন যেন ধীর, মিশ্র ও নৈরাশ্যজন্ক, অথচ অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনুযায়ী ইতিমধ্যেই প্রত্যক্ষ করের মুখ্য ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। পর্যালোচনায় দেখা যায় ক্রমশ কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত কর আয়ের অনুপাত ৭০:৩০ থেকে ৫৫:৪৫ এ পৌঁছিয়েছে। দেশে করপোরেট ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও কোম্পানি প্রদত্ত আয় করের প্রবৃদ্ধি সেভাবে বা সে হারে বাড়েনি বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে কোম্পানি ব্যতীত কর দাতার মধ্যে ব্যক্তি করদাতা, পার্টনারশিপ ফার্ম, অ্যাসোসিয়েশন অব পার্সন, আর্টিফিশিয়াল জুরিডিক্যাল পার্সনস রয়েছেন-তাদেরকে কর নেটের আওতায় আনার উদ্যোগ আরও জোরদার করণের অবকাশ রয়েছে। ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা (টিআইএন ধারীর হিসাব অনুযায়ী) নিকট অতীতেও যথাযথভাবে শুমার ও সংরক্ষণ করা না হলেও যখন থেকে এসবের অগ্রগতির পরিসংখ্যান পর্যালোচিত হচ্ছে তখন থেকে অগ্রগতির ধারা বেগবান করার প্রয়াস চলছে। যারা আয়কর নথি খুলেছেন তাদের শতকরা মাত্র ২৫-৩০ ভাগ করদাতা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, বাকিদেরেকে উপযুক্ত অনুসরণের উদ্যোগ জোরদার করার আবশ্যকতা রয়েছে। আয়কর বিভাগের লোকবল বাড়ানো ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যমান লোকবল ও কাঠামোকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো এবং দেশিক দায়িত্ব শীলতার সাথে প্রত্যক্ষ কর প্রশাসন-ব্যবস্থাপনা- প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ধার্য ও আদায়কৃত আয়কর যথাসময়ে ও প্রকৃত পরিমাণে কোষাগারে আসার ব্যাপারে নজরদারি ও পরিবীক্ষণ যেমন জরুরি তেমনি করারোপ, হিসাবায়ন ও জমা দান পদ্ধতি প্রক্রিয়াকে যতটা সম্ভব করদাতা বান্ধব বা সহজিকরণ করা যাবে তত দূরত্ব কমবে করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে। আর এভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হলে কর নেটের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকবে। একথা অনস্বীকার্য যে সার্বিক রাজস্ব আয়ের পরিবারে প্রত্যক্ষ করকে মোড়লের ভূমিকায় আসার যথেষ্ট অবকাশ ও সুযোগ রয়েছে।
এখনো সবাই শুনছে বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশটি নতুন মলাটে আইন হিসেবে প্রমিত করণের কাজ শেষ পর্যায়ে। রাজস্ব আইনের সঙস্কারের এ আয়োজন উদ্যোগ সহসা সচকিত নয়, দীর্ঘদিন ধরে [RTF bookmark start: }_GoBack[RTF bookmark end: }_GoBackচলছে পরিকল্পনা আর প্রাজ্ঞ পরামর্শকদের প্রয়াস পারঙ্গমতা। রাজস্ব আইন সংস্কারের সকল উদ্যোগের আগ্রহ অভিপ্রায়ে কোনো কমতি নেই, কিন্তু বিদ্যমান আইনে ‘শতেক শতাব্দি ধরে নামা শিরে অসম্মানভারের’ লাঘব প্রকৃতপ্রস্তাবে ঘটছে কিনা, সংস্কারকৃত আইন কতটা বাস্তবায়নসম্মত, আয়কর আহরণকারী এবং দাতার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও বাধ্যবাধকতার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন অনিবার্য হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর আইনের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি হলে দেখা যাবে এ আইন জন্মগতভাবে ব্রিটিশ, দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক, এবং প্রয়োগিক দিক থেকে জটিল, নিবর্তন ও প্রতিরোধাত্মক। এ দেশে ভূমি কর বা রাজস্ব আদায় এর প্রথা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে চলে এলেও এদেশে আধৃনিক আয়কর প্রবর্তিত হয় উনবিংশ শতাব্দির ষাট এর দশকে। আমরা জানি এ দেশ ১৭৫৭ সালে ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়। পরবর্তী ১০০ বছরে এদেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভরকরণ কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর এ দেশের শাসনভার কোম্পানির থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতে প্রধম ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জেমস উইলসন (১৮০৫-১৮৬০) তার বাজেট বক্তৃতায় এ দেশে প্রথম আধুনিক আয়কর প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। আয়কর আইন প্রবর্তনের দুমাসের মাথায় ডিসেন্ট্রিতে কলকাতাতেই মারা যান উইলসন ।
প্রথম থেকেই আদায়ের ক্ষেত্রে করদাতাদের প্রতি বশংবদ অদায়িত্বশীল আচরণ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ফাঁকিঝুঁকি প্রতিরোধত্মক ঔপনিবেশিক মনোভাব প্রাধান্য পায় । কর যোগ্য আয় নির্ধারণ থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে পরিপালনীয় বিধিবিধানের ভাষা জটিল ও দ্ব্যর্থ বোধক হয়ে ওঠে। ‘তোমার আয় হোক আর না হোক অর্থাৎ বাঁচ-মরো রাজস্ব আমার চাই’ এ ধরনের আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির বদৌলতে কর আদায়কারী বিভাগের সাথে করদাতাদের সম্পর্ক জবরদস্তিমূলক, পরস্পরকে এড়িয়ে চলার কৌশলাভিমুখি হয়ে পড়ে। পরস্পর অবিশ্বাসের ও প্রতিদ্বন্দ্বি পরিবেশে কর নির্ধারণ ও পরিশোধের ক্ষেত্রে পরস্পরকে এড়িয়ে চলার এবং সে লক্ষ্যে অনৈতিক আঁতাতের মাধ্যম রাজস্ব ফাঁকির সংস্কৃতিরও সূত্রপাত ঘটে। দুর্নীতিগ্রস্ততার পরিবেশ সৃষ্টিতে আইনের মধ্যেই যেন রয়ে যায় পরোক্ষ প্রেরণা বা সুযোগ। এমন অনেক আইন আছে যা বেআইনি আচরণকে উসকে দেয়।
সুষ্ঠু বাস্তবায়নের প্রশ্নে এ দেশের আয়কর আইন হবে এদেশেরই আবহমান অর্থনীতির আবহে লালিত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলক, হবে সহজবোধ্য, জটিলতা পরিহারী এবং এর প্রয়োগ হবে স্বাচ্ছন্দে সার্বজনীন ব্যবহার উপযোগী। তবেই বাড়বে এর গ্রহণ এবং বাস্তবায়নযোগ্যতা। করদাতা যেন নিজেই নিজের কর ফরম পূরণ, কর নির্ধারণ এবং সরাসরি তা দাখিলে সক্ষম হন। অর্থনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থানরত কর দাতাগণ যেন অভিন্ন আচরণে আইনগতভাবে কর প্রদানে দায়িত্বশীল হতে স্বতস্ফুর্ততা বোধ করেন। কর আদায় নয়, কর আহরণে কর দাতা ও কর আহরণকারীর মধ্যেকার দূরত্ব যত কমে আসবে, যত অধিকমাত্রায় করদাতা কর নেটের আওতায় আসবেন, তত কর রাজস্ব আহরণে সুষম, সহনশীল ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটবে। এমন পরিস্থিতিতে কর দাতাকে তাড়া করে ফেরার মতো স্পর্শকাতরতার অবসান ঘটবে ।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
আপনার মতামত লিখুন :