মতিনুজ্জামান মিটু: এদেশে কৃষি প্রধানত অলাভজনক ও প্রকৃতি নির্ভর ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। কোনো ফসলেরই নায্য দাম নেই, কৃষকের বড়ই দুর্দিন। মাসের হিসেবে একজন কৃষকের আয় গার্মেন্টস শ্রমিকের চেয়েও কম। বিভিন্ন পর্যায়ের কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে আলাপ করে হতাসাজনক এসব তথ্যগুলো উঠে এসেছে।
কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের উপ প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ মো. নূরুল ইসলাম বলেন, শৈশব-কৈশোর কাল থেকে দেখে আসছি আমার গ্রামের বেশকিছু কৃষক পরিবার, যাদের এক সময় অনেক অনেক কৃষি জমি ছিল। এসব কৃষক পরিবার যতদিন শুধু চাষবাসের উপর নির্ভর ছিল ততদিন তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বছর বছর জমি বিক্রি করে, লোন করে, জমি বন্ধক রেখে দিন গুজরান করেছে। শুধুমাত্র সেইসব কৃষি পরিবার মোটামুটি ভালমতো দিন যাপন করতো, যারা পরিবারের বাপ-মা-ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনি মিলে ক্ষেতে খামারে কাজ করেছে। যাদের জমি বেশি ছিল অর্থাৎ ধনি লোক, তাদের অবস্থা বেশি খারাপ ছিল, কারন মান সম্মানের জন্য তারা ক্ষেতে কাজ করতে পারতো না। তারপর দেখেছি যখন এসব পরিবারের দু-একটা ছেলে মেয়ে শিক্ষিত হলো, প্রাইমারী বা হাই স্কুলের মাস্টারির চাকরি পেল, কেউবা পুলিশ, বিডিআর, আর্মির কন্সটেবলের চাকরি পেল, কেউ এনজিওতে,কেউ গার্মেন্টসে, কেউ চিনিকলে ইত্যাদি চাকরি পেল। তারপর ধীরে ধীরে এসব পরিবার সচ্ছল হলো। তখন আর তাদের জমি বিক্রি করে খেতে হতো না। এখনো কিছু পরিবার আছে যাদের কারোরই চাকুরী হয়নি তারা এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছে, এবং দিনে দিনে জমি বিক্রি করে খাচ্ছে। এই হলো এদেশের কৃষক পরিবারের জীবন যাপনের ইতিকথা।
তিনি বলেন, কৃষি এখনো সেই তিমিরেই রয়ে গেছ। এখনো একবার ধানে লাভ হলে পাটে লস হয়, পাটে লাভ হলে বেগুনে লস হয়, করলায় লাভ হলে ঢেরসে লস হয়, কলায় লাভ হলে পেপেতে লস হয়, পেয়াজে লাভ হলে রসুনে লস হয়! ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন কি ইদানিং আম, লিচু,পেয়ারা,কুলেও মারাত্মক লস দিতে হচ্ছে চাষিদের। এদেশের চাষি স্ট্রবেরীর মত অভিজাত ফল চাষ করেও লস খেয়ে এখন চাষ করাই বাদ দিয়েছে। বাকি আছে শুধু ড্রাগন ফল, ডুয়ার্ফ ডাব, বারহি খেজুর, এভাকার্ডো, রামবুটান আর সীডলেস পেয়ারা। আমি শিওর যে এভাবে অপরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ করলে বর্তমানের এসব হাই ভেলু ফলেও চাষিরা একদিন লোকসান গুনতে বাধ্য হবে। বর্তমান অবস্থায় যেসব চাষির শত শত একর জমি আছে তারাই কেবল জমি লিজ দিয়ে বা বর্গা দিয়ে লাভজনক ভাবে জীবন যাপন করছে, নিজেরা চাষাবাদ করে নয়। আর যারা পরিবারের সবাই মিলে জমিতে শ্রম দিচ্ছে তারাই লাভের মুখ দেখছে অর্থাৎ শ্রমের মূল্যটুকু লাভ হচ্ছে। বর্তমান অবস্থায় শতভাগ লেবার খরচ করে কৃষিতে লাভ করা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে! এই হল বর্তমানের কৃষি ও কৃষকের বাস্তব অবস্থা।
তিনি আরো বলেন, অবস্থা বুঝে সুবিধামতো সময়ে হঠাৎ কোনো এক বছরে বাম্পার ফলন করে পেপে বাদশাহ, গাজর জাহিদ ও কুল ময়েজ'রা ভাল ফলাফল দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট পদক পেলেও তারা কেউই এখন আর ভাল নেই! যা আমি ব্যাক্তিগতভাবে জানি। বর্তমানে দেশে যে যত বেশি জমিতে বাইরের লেবার নিয়ে আবাদ করবে সে তত বেশি লস খাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কৃষিবিদ নূরুল ইসলাম বলেন, সরকার ভর্তুকি মুল্যে সার দেয়ায় লসের পরিমান কিছু কম হচ্ছে বৈকি, তা নাহলে কৃষি টিকেই থাকতে পারতো না। দেখা গেছে দু'একটা ফসলে একবার লাভ হয় তো পরেরবার দ্বিগুণ ক্ষতি হয়! যাদের লাভ হয়, তা এতো সামান্য যে মাসিক আয় হিসাবে হিসাব করলে দেখা যাবে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের চেয়েও মাসে কম ইনকাম হচ্ছে! এ বাস্তবতার আলোকে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের সকল সরকার কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে এ খাত টিকিয়ে রেখেছে। কেননা রুটি রুজির জন্য মানব সভ্যতা কৃষির উপর শতভাগ নির্ভরশীল। কৃষি উৎপাদন নাহলে খাদ্য দ্রব্যের অভাবে মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে,সকল দেশের সরকাররা একথা ভালমতোই জানে!
তিনি বলেন, একথাও মনে রাখতে হবে যে, একটা নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর একটা এলাকার কৃষি উৎপাদন নির্ভর করে। যদি কোনো কারনে শীতের সময় বর্ষা আর বর্ষার সময় খরা বা খরার সময় বর্ষা হয় তাহলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হতে বাধ্য, কেননা একটা নির্দিষ্ট এলাকার কৃষি ওই এলাকার জলবায়ুর উপর গড়ে উঠে। হাওরের মত হঠাৎ বন্যা, তীব্র খরা, অতিবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, আইলা, সিডর, সাইক্লোন তথা ব্লাস্ট, পংগপাল এখনো মানুষ সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা, যার খেসারত দিতে হয় নিরীহ কৃষককে!
তিনি আরো বলেন, যতদিন পর্যন্ত এ দেশে সুপরিকল্পিতভাবে কৃষি পন্যের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করা সম্ভব হবেনা, ততদিন পর্যন্ত কৃষি পন্যের স্বাভাবিক মূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবেনা। কেননা কোটি কোটি মানুষ নিরুপায় হয়ে কৃষি পেশার সাথে জড়িত যারা মূলত অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত এবং যাদের আই কিউ অনেক কম। এদের কৃষিতে ধরে রাখার জন্য প্রতিটি ফসলে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা দরকার।
বর্তমানে দেশে আখ ছাড়া কোন অন্য কোনো ফসলের সরকার ঘোষিত নির্ধারিত মূল্য নেই। সৌভাগ্য বশত সরকার গত তিন বছরে তিনবার আখের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। তাই সুগারমিল জোন এলাকায় আখই বর্তমানে সর্বাধিক লাভজনক ফসল, কাজেই দিধাদ্বন্দ ভুলে এখন সবারই আখ চাষে ঝাঁপিয়ে পরা উচিত। পাশাপাশি সুগারমিল জোন এলাকার বাইরে অন্যান্য ফসল উৎপাদনে যাতে চাষিরা লোকসান না খায় তার জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহনের সময় এসেছে, অন্যথায় শুধু মুখের কথায় কৃষি উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব হবেনা। তাই বর্তমানে অলাভজনক প্রকৃতি নির্ভর ঝুকিপুর্ন কৃষি পেশাকে চাষির নিকট লাভজনক করার পন্থা উদ্ভাবনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এই কৃষিবিদ।