ড. সেলিম জাহান : সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়ে গেল। সে যে কি এক গর্বের আর আনন্দের বিষয় আমার জন্যে! যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে জীবনের প্রায় পঁচিশটি বছর কাটিয়েছি, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আরো একদল তরুণ বন্ধুরা উচ্চশিক্ষা সমাপান্তে জীবনের বৃহত্তর অঙ্গনে প্রবেশ করছেন, এ আমার গর্ব। সমাবর্তনের আনুষ্ঠানিক পোশাক-আশাকে সুসজ্জিত উচ্ছ্বসিত বহু তরুণ শিক্ষার্থীর একক, দ্বৈত কিংবা দলগত ছবি দেখে আনন্দে মনটা ভরে গেছে। আর কোন কোন ছবি তো অনন্য সাধারণ ঐ যে এক তরুন তার সমাবর্তনের আনুষ্ঠানিক পোশাকটি পরিয়ে দিয়েছেন তার রিক্সাচালক পিতাকে এবং টুপিটি তার মাতাকে, তার কি কোন তুলনা আছে?
অনুষ্ঠিত হয়, তখন অনেক আনন্দের মাঝেও এক অজানা বিষাদে আমার মন ছেয়ে যায়। পঁচিশ বছর ছাত্র-শিক্ষক হিসেবে জড়িত থাকলেও আমি সে সময়কালে কিংবা তার পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সমাবর্তনে যোগ দিতে পারিনি। সম্ভব হয়নি কখনোÑকারণ সমাবর্তনই হয়নি। আমাদের সমসাসাময়িক বন্ধু-বান্ধব ও সতীর্থদের এটাইতো অভিজ্ঞতা। তবে আমার এ বঞ্চনার পাল্লা আরো একটু বেশ ভারী। কারণ ১৯৮৩ সালে ক্যানাডায় ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ ডি সমাপান্তিক সমাবর্তনেও আমি থাকতে পারিনি। কমনওয়েলথ বৃত্তির শর্ত অনুসারে সমাবর্তনের পূর্বেই আমাকে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। সুতরাং আমি এ জীবনে সমাবর্তনবঞ্চিত।
তবে এতো আশাভঙ্গের মধ্যেও দু’টো কথা ভাবলে মন জুড়ে গর্বের একটা লাভা স্রোত বয়ে যায়। প্রথমত ক্যানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে আমি আমার দুকন্যার একাধিক সমাবর্তনে যোগ দিয়েছি বার্কলে, ম্যাকগিল, সেইন্ট মেরী ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন গর্বিত পিতার জন্যে সে এক বিরাট অহংকার।দ্বিতীয়ত গত প্রায় তিন দশকে বিশ্বের বিভিন্ন নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে আমি আমন্ত্রিত হয়েছি এবং সে সূত্রে আমি বিশ্বের বেশ কিছু অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বের সমাবর্তন ভাষণ সামনাসামনি শুনেছি। এর মধ্যে রয়েছেন ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপ্রধান, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, লেখক, অভিনেতা জিমি কার্টার, বিল ক্লিন্টন, বারাক ওবামা, অমর্ত্য সেন, ইলি ওয়াজেল, মাযা এ্যাঞ্জেল, নাদিন গর্ডিমার, স্টিভ মার্টিন, অ্যালান অল্ডা, ডেন্জেল ওয়াশিংটন প্রমুখ।
উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের কথা ও বক্তব্য শোনাকে আমি আমার জীবনের এক পরম প্রাপ্তি বলে মনে করি। নমিত হয়েছি বারবার এ অতুলনীয় সুযোগের জন্য। কত কিছু যে শিখেছি, শুধুমাত্র বক্তৃতার বিষয়বস্তুর জন্যে নয়, প্রক্রিয়া বিষয়েও কি করে বক্তব্য দিয়ে শ্রোতৃবৃন্দের হৃদয়তন্ত্রীতে নাড়া দিতে হয়, কেমন করে কথা দিয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়। এ সব অসাধারণ মানুষদের সমাবর্তন বক্তৃতা আমাকে নিরন্তর অভিভুত করেছে তাদের প্রসাদগুনে।
এ সব গুনিজনের সমাবর্বতন বক্তব্য-বিষয় ও বাচনভঙ্গিতে তফাৎ আছে বিস্তর অন্তত শ্রোতা হিসেবে আমার তা মনে হয়েছে। বারাক ওবামা কিংবা অমর্ত্য সেনের সমাবর্তন ভাষণে একজন দার্শনিকের মনোভঙ্গি খুঁজে পেয়েছি। জিমি কার্টার বা ইলি ওয়াজেলকে মনে হয়েছে উন্নয়নতৎপর কর্মি। নাদিন গর্ডিমার বা মায়া এ্যাঞ্জেল সাহিত্যের আতশ কাঁচের মাধ্যমেই জীবনের মূল্যবোধের কথা বলেছেন। উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও নানান পন্থা অবলম্বন তরেছেন। বিল ক্লিটন বা ডেনজেল ওয়াশিংটন তাদের ব্যক্তিগত জীবন আলেখ্য দিয়ে শুরু করেছিলেন বক্তব্য, বেশ সরস ভঙ্গীতে। আ্যল্যান অল্ডা বা স্টিভ মার্টিন নিজেদের নিয়ে কৌতুক পরিহাস করেছেন ঠিকই। কিন্ত তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে ব্যক্তিকরণের মাধ্যমে বিদায়ী ছাত্রদের তাদের দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়া।
যে কোন বিশ্বিববিদ্যালয়ে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের কাছে সমাবর্তন ভাষণের একটি আলাদা একক মর্যাদা আছে। আছে একটি উচ্চতর প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের পিতামাতার, সমাজের ও দেশবাসীর। একটি দেশের নানান অঞ্চল, নানান আর্থসামাজিক গোষ্ঠী থেকে সযতে্ন বাছাই করা একদল ছেলে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পা রাখে, চোখে স্বপ্নের অঞ্জন মেখে। চারবছর বাদে তারা যখন সমাবর্তন উঠোনে পৌঁছায়, তখন তারা উপলব্ধি করতে পারে যে শিক্ষাঙ্গণ পেরিয়ে তারা জীবনাঙ্গণে পা রাখতে যাচ্ছে।
একটি নিশ্চিত পরিবেশ থেকে তারা যাত্রা শুরু করবে, একটি অনিশ্চিত বলয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদ প্রাপ্তিতে তাদের যেমন একটা আনন্দ থাকে, তেমনি থাকে সতীর্থ বন্ধুদের আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা। সে মুহূর্তে সমাবর্তন ভাষণের কাছে তারা প্রত্যাশা করে আশ্বাসের, আশার, আস্থার। তারা চায় সহযোগিতার বাণী, সাহায্যের আশ্বাস। তারা তাদের স্বপ্নের অনুমোদন চায় সমবর্তন বক্তৃতায়। বিষয়বস্তু এবং উপস্থাপনার পার্থক্য সত্ত্বেও এই সব সমাবর্তন ভাষণের একটি অভিন্ন সুর থাকা উচিত সেটি হচ্ছে, তরুণ সমাজকে উদ্দীপ্ত করা। তাদেরকে বোঝানো যে তাদের সম্ভাবনার কোন সীমারেখা নেই আকাশ তাদের সীমানা। সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার দ্বারা তারা পৃথিবীর খোল-নলচে বদলে দিতে পারে। সেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া যে আগামী পৃথিবী তাদের জন্য এবং এ পৃথিবীর প্রতি তাদের বহুধামাত্রিক একটি দায়িত্ব আছে। বিভিন্ন সময়ে এ জাতীয় সমাবর্তন বক্তৃতা শুনে আমি বুঝতে পেরেছি যে, সমাবর্তন ভাষণ একটি সাধারণ ভাষণ নয়, এটি একটি শ্রেণিকক্ষ বক্তৃতা নয়, একটি হালকা মেজাজের নাটকীয় বক্তব্যও নয়।
বিষয়বস্তু ও উপস্থাপন ভঙ্গির তারতম্য সত্ত্বেও এর চরিত্র উচ্চতর ও গভীরতর।
শিক্ষাজীবন শেষে বৃহত্তর জীবনে প্রবেশের মুখে শেষ যে কথাগুলো আমরা শুনি বিশিষ্ট গুনীজনের কাছ থেকে, তার মান, প্রাসঙ্গিকতা ও দূরদৃষ্টিতার প্রত্যাশিত মান অনন্য বিদায়ী ছাত্র-ছাত্রীদের নিকটে তো অবশ্যই, সেই সঙ্গে আপামর জনসাধারণের কাছে। এ কথাটি আমরা যাতে বিস্মৃত না হই।