মোহাম্মদ আলী বোখারী : নিউইয়র্ক টাইমসে ২০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ‘ট্রাম্প ভায়োলেটস হিজ ওথ্’, অর্থাৎ ট্রাম্প তার শপথ ভঙ্গ করেছেন, এই উপসম্পাকীয়টিতে ডেভিড লিয়নহাড্থ লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ‘প্রিসার্ভ, প্রোটেক্ট অ্যান্ড ডিফেন্ড’ বা সংরক্ষণ, সুরক্ষা ও প্রতিহতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার যুক্তিÑ রাশিয়া ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে আক্রমণ করেছে, এই আক্রমণের বিষয়টি আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার কাছে উন্মোচিত, বর্তমান প্রেসিডেন্ট সেটি স্বীকার বা তার জবাবদিহিতা দেননি কিংবা ভবিষ্যতে অনুরূপ আক্রমণ থেকে সুরক্ষায় এগিয়ে আসেননি এবং সর্বশেষ ফ্লোরিডায় ১৭ জন ছাত্রের গণহত্যায় রাশিয়া বিষয়ক তদন্তের অজুহাতে গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের ব্যর্থতাকে তুলে ধরেছেন, যাতে অব্যাহতভাবে ট্রাম্পের মিথ্যাচারিতাটি প্রকাশ পেয়েছে।
একইসঙ্গে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক বিষয়ক ‘দ্য আটলান্টিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত কানাডার সাংবাদিক ডেভিড ফ্রাম রচিত ‘আমেরিকা ইজ আন্ডার অ্যাটাক অ্যান্ড দ্য প্রেসিডেন্ট ডাজেন্ট কেয়ার’ নিবন্ধের উদ্ধৃতিতে বলেছেন, ট্রাম্প জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেননি।
এতে ওই উপসম্পাদকীয়টির আলোকচ্ছটায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তম প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক ভারতের ঐতিহ্যবাহী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়টি অতি গুরুত্বে বিবেচনা করা জরুরি। কেননা ‘এ নেরোয়ার ফিল্ড’ বা ‘সংকীর্ণতম অঙ্গন’ শিরোনামযুক্ত তাদের সম্পাদকীয়টি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার একচ্ছত্র প্রয়াসটিকে প্রতিবিম্বিত করে উপশিরোনাম করেছে, ‘জেইলিং অব খালেদা জিয়া রিভাইভব্স কোয়েশ্চেন্স অ্যাবাউট শেখ হাসিনাজ পারস্যুট অব অ্যাবসোলুট পাওয়ার ইন বাংলাদেশ’। তার ব্যাখ্যায় লিখেছে, ‘ইন পাবলিক পারসেপশন, হাউএভার, জিয়াজ ইনকারসারেশন পেভস্ দ্য ওয়ে ফর এ ফার্দার কনসোলিডেশন অব প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনাজ ভাস্ট পলিটিক্যাল পাওয়ার’।
অর্থাৎ জনগণের দৃষ্টিতে কারারুদ্ধ বেগম জিয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশাল রাজনৈতিক শক্তিটি দৃঢ়করণ হয়েছে। আরো লিখেছে, এ বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি নেতাকে অংশগ্রহণ করতে দেয়া না হলে এবং তার দল পাঁচ বছর আগের মতো নির্বাচন বর্জন করলে, হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ অপ্রতিরোধ্যভাবে (আনট্রামেল্ড) ক্ষমতা কুক্ষিগত করবে; যেখানে অনেকেই মনে করেন, তিনি বাংলাদেশকে তুলনামূলক কম গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রে প্রতিপন্নে উদ্বুদ্ধ হবেন অর্থাৎ ‘শি মে বি টেম্পটেড টু ট্রান্সফর্ম বাংলাদেশ ইন্টু এ স্টেট লেস ডেমোক্রেটিক’। অবশ্য সেই দিনটি এখনো বেশ দূরে। কিন্তু বাস্তবতাটি হচ্ছে, ১৯৭৫ সালে যে আততায়ীর গুলিতে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবার সদস্যদের নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তার সাহসিকতায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, সেই খ্যাতিটি দ্রুতই ম্লান হচ্ছে।
রক্ত¯œাত যুদ্ধে অর্জিত জাতিটি সেসময় ছিল অনেক নবীন। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে তার উপেক্ষাজনিত স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও বিভেদের রাজনীতিতে বাংলাদেশিরা ক্ষুব্ধ, যা প্রকারান্তরে তাকে অজনপ্রিয়তার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সকল হিসেবেই বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে তিনি তার ব্যক্তিগত আক্রোশটি ভুলে যাননি। তার বিশ্বাস, বিএনপি দলটি জামায়াতে ইসলামীর হাতমোজাবদ্ধ, যার অনেক নেতাই স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন শত্রু পাকিস্তানের সহযোগী ছিল। সেটি কিছুটা হলেও সত্য। তাতে হাসিনার মানসিক যাতনা, এমনকী ব্যক্তিগত প্রতিশোধপরায়নতা উপলব্ধিযোগ্য। কিন্তু একজন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভের বেদীতে নিজেকে সমর্পণ প্রকারান্তরে তার দেশকে ভবিষ্যতে অধঃপতনে ধাবিত করবে।
গণতান্ত্রিক পরিসর সৃষ্টিতে হাসিনার অক্ষমতাটি হচ্ছে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিচারের ভার জনগণের কাছে তুলে দিচ্ছেন না, যে চেতনায় স্বাধীনতাযুদ্ধে অধিকাংশ বাংলাদেশি অংশ নিয়েছেন, যেখানে বেগম জিয়ার স্বামী তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন এবং শেখ মুজিবের পক্ষে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছেন। অন্যত্র হাসিনার ক্ষেত্রে, তিনি অতি সাহসিকতায় উভয় সন্ত্রাসী ও ইসলামী উগ্রপন্থীর বিরুদ্ধে লড়েছেন, যা দৃশ্যত বেগম জিয়ার ভঙ্গুর রাষ্ট্রের বীজ বপনের নিপতিত পরিবেশটি সৃষ্টি করেছে। কোর্ট জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে ভালোই করেছে। কিন্তু আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তলিয়ে দেখা দরকার যে জাতিগঠনে তার অবিচলতাটি গণতান্ত্রিক ও সংবেদনশীল হওয়া চাই।
অতএব, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার উল্লেখিত হুবহু সম্পাদকীয়টি যেহেতু বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরে রাজনৈতিকভাবে ‘জাতিগঠনে তার অবিচলতাটি গণতান্ত্রিক ও সংবেদনশীল হওয়া চাই’ বলে শেষ করেছে, সেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শপথানুসারে আদৌ ‘ব্যক্তিগত প্রতিশোধপরায়নতায় গণতান্ত্রিক পরিসর সৃষ্টিতে অক্ষম কিনা’, আপামর জনসাধারণ তা জানার অধিকার রাখে বৈকি!
ই-মেইল :bukhari.toronto@gmail.com