মোহাম্মদ আবু নোমান : পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের পর মৃত্যু হলে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল চাওয়া, মৃত্যুর দায়ভার থেকে মুক্তি চাওয়া কি মানব সেবা? পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রতিটি কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তখন পুলিশ আবারও কিভাবে সাহস করলো নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনটি সংশোধনের দাবি করার? মানবাধিকারের প্রশ্ন জড়িত আছে এমন একটি আইন সরাসরি সরকার প্রধানের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে কী করে বাতিল বা সংশোধন চাওয়া সম্ভব? আমরা মনে করি, এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ওদাসীনতা দেখানো উচিত নয়।
ইতোপূর্বে পুলিশ সপ্তাহ ২০১৭-এ পুলিশের পক্ষ থেকে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটি বাতিলের দাবি তোলা হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী সেটি নাকচ করে বলেছিলেন, সংসদে পাস করা আইন বাতিল করা সমীচীন কি-না, সেটা তার জানা নেই। এবছর আবারও পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে আইনটি বাতিল না হলেও অন্তত সংশোধনের দাবি তোলা হয়। এ আইন পুলিশের অধিকার খর্ব করছে বলে অনেক দিন ধরেই বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। পুলিশের একটি উল্লেখযোগ্য মহল শুরু থেকেই আইনটিকে ভালোভাবে নেয়নি। মূলত সংশোধন, না আইনটির বাতিল চায় তারা? যদিও আইনটি একটি কাগুজে আইন হিসেবেই রয়ে গেছে। বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না। তারপরও পুলিশের বার বার তাগাদা দেওয়ার কারণ কি?
নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম ৯ মাসে পুলিশি হেফাজতে ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ আইন বাতিল বা সংশোধন করলে সন্দেহ বা অনুমান, আন্দাজে ধরে পুলিশের মারতে সুবিধা হবে- পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর হার যে আরও বাড়বে এটা বুঝতে কারো বড় বিদ্যান হবে হবে না। ‘দুপুরে আটক, বিকালে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু’ ‘চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু’। নিহতের স্বজনদের দাবি পুলিশের নির্যাতনেই মারা গেছেন। এরকম খবর পড়তে বহু আগে থেকেই অভ্যস্ত এদেশের মানুষ। এ আইন সংশোধন বা বাতিল চাওয়ার অর্থ পুলিশ হেফাজতে আইন করে মানুষ মারা?
বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিখোঁজ নাগরিকের সন্ধান দিতে না পারা ও পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু কোনো স্বাধীন-সভ্য দেশে হবে পারে না। মানবাধিকার সুরক্ষায় সাংবিধানিকভাবে সরকার দায়বদ্ধ। নাগরিক নিখোঁজ থাকবে আর তার পরিবার-পরিজন দ্বারে-দ্বারে কান্নাকাটি করবে, বিচার চাইবে, এটি সভ্যসমাজের লক্ষণ নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনাই সহ্য করার নয়। বিচারবহির্ভূত যে কোনো কাজই আইনের শাসনের পরিপন্থী। যে কোনোভাবেই মানুষের সাংবিধানিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারের সম্মুখীন না করে কাউকে হত্যা করা অপরাধ।
পুলিশের হেফাজতে নির্যাতনের শিকার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে বেসরকারি বিল হিসেবে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) বিল উত্থাপন করেছিলেন। নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতার জন্য এ আইন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, আগে একটা কথা ছিল ‘বাঘে ধরলে এক ঘা, পুলিশে ধরলে ১৮ ঘা’। আবহমান কাল থেকে বাংলায় এ প্রবাদ চলে আসছে। কারণ বাঘে ধরলে আহত হয়ে তাও বাঁচার সম্ভবনা আছে, কিন্তু পুলিশের খপ্পরে পড়লে...। এজন্য দেশের সাধারণ মানুষ থানা, পুলিশ, কোর্ট-কাচারি থেকে দূরে থাকে। একথা অনস্বীকার্য যে, দেশে দূর্নীতির প্রকোপ এত মারাত্মকভাবে বিস্তৃত লাভ করেছে যে, এখন কোথায় দুর্নীতি হয়, একথা জিজ্ঞেস না করে, কোথায় দুর্নীতি হয় না একথা জিজ্ঞেস করাই যুক্তিযুক্ত। এখন দেশে একধরনের রিমান্ডের শাসনের সাথে যাকে তাকে ধরে ক্রসফায়ার, নিখোঁজ, গুম আর বন্ধুক যুদ্ধের নামে নানা ঘটনা চলছে। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের কোনো মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা পুলিশের কাছ থেকে বিনালাভে কখনো বিন্দু পরিমাণ উপকার বা সেবা পাওয়ার দৃষ্টান্ত হয়তো(!) আছে; কিন্তু কতটুকু তা সচেতন পাঠকের বিবেকের আদালতেই ছেড়ে দিলাম।
তারপরও পুলিশের স্বল্প কিছু অর্জন থাকলেও এই সব দুস্কৃতিকারীদের জন্য ধুলায় মিশে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, ঘুষখোর ও চাঁদাবাজ পুলিশ সদস্যের অপকর্মের দায় গোটা বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর ওপর অবিচারের নামান্তর।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ