এল আর বাদল : পরিচালকদের অনাস্থায় পদচ্যুত হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদ৷ তার চেয়ারে এখন আরেক সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল৷ ক্ষমতার এই পালাবদলে আইসিসির নিষেধাজ্ঞার শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও বদলে যায়। নাজমুল হাসান পাপনের জায়গায় নতুন বিসিবি প্রধান হন সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ। তবে আরেকটি আগস্ট আসার আগেই গত বৃহস্পতিবার পদচ্যুত হয়েছেন ফারুক। দায়িত্ব নেওয়ার ৯ মাস না যেতেই বিসিবির আটজন পরিচালক অনাস্থা জানান সভাপতির প্রতি। নতুন বোর্ড সভাপতি হিসেবে শুক্রবার নির্বাচিতও হয়েছেন সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল।-- সূত্র, ডয়েচেভেলে
-- ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ--
বৃহস্পতিবার ১০ সদস্যের বিসিবি বোর্ডের ৮ পরিচালকই ফারুক আহমেদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দেন। সেই চিঠিতে ফারুককে ‘স্বেচ্ছাচারী', ‘আধিপত্যবাদী' বলা ছাড়াও অভিযোগ ছিল আরও কিছু। ফারুক আহমেদকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়েই পরিচালকদের সেই প্রস্তাবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) ফারুকের মনোনয়ন বাতিল করে দেয়।
ফারুক যে উপায়ে সভাপতি হয়েছিলেন, অপসারিতও হলেন একই সূত্র ধরে। এর আগে অবশ্য যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার বাড়িতে বুধবার বৈঠক করেছিলেন ফারুক। সেখানে তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন সজীব ভুঁইয়া। কিন্তু ফারুক পদত্যাগ না করে বাংলাদেশের একাধিক গণমাধমে বলেন, ‘‘আমি কেন পদত্যাগ করব? আমাকে কোনো কারণ জানানো হয়নি। যদি বলা হতো, আমি কোথায় ব্যর্থ হয়েছি, তাহলে বুঝতাম। শুধু জানানো হয়েছে, উপরমহল আমাকে আর চায় না। কোনো ক্রিকেটীয় কারণ বলা হয়নি। তাই পদত্যাগ করব না।''
সেই কারণটা অবশ্য ফারুককে অপসারণ করার পর জানায় এনএসসি। ২০২৫ বিপিএলে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক ইস্যুতে সত্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করে তারা। সেই রিপোর্টে অব্যবস্থাপনার সব দায় দেওয়া হয়েছে ফারুকের কাঁধে। মনোনয়ন বাতিলে এনএসসি সামনে এনেছে এটাই। অথচ বিপিএলের সঙ্গে অনেকের সংশ্লিষ্টতা থাকে। কেউ একা এটা আয়োজন করতে পারেন না।
ঘটনার পেছনে আরও কিছু ঘটনা আছে। ফারুক আহমেদের বিপক্ষেও অভিযোগ ছিল অনেক। যেমন তিনি একক ক্ষমতায় সরিয়ে দিয়েছিলেন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে। দায়িত্ব নেওয়ার পাঁচ মাস পর বিসিবির বিভিন্ন কমিটি পুনর্গঠন করলেও সবাইকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেননি তিনি। এটা নিয়েও এনএসসিতে অভিযোগ দিয়েছেন আট পরিচালক।
-- পালাবদলে তাড়াহুড়ো?--
ফারুক আহমেদের চেয়ারে এখন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। সেই প্রক্রিয়াও সারা হয়েছে দ্রুততম সময়ে। বিসিবির সভাপতি হতে হলে প্রথমে হতে হবে কাউন্সিলার, তারপর বোর্ডের পরিচালক, এরপর ভোটে হতে হবে নির্বাচিত। কিন্তু আমিনুল ইসলাম কাউন্সিলরই ছিলেন না! বৃহস্পতিবার রাতে বিসিবির জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) মনোনীত কাউন্সিলর হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয় আমিনুল ইসলামকে।
এনএসসির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ: ১৩.২ (খ) (৪) মোতাবেক মো: আমিনুল ইসলামকে পরিচালক হিসেবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কর্তৃক মনোনীত করা হলো।
অনলাইন সভায় আমিনুলের কাউন্সিলরশিপ দ্রুত অনুমোদনও করেন ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালকরা। তাই নতুন বিসিবি সভাপতি হতে কেটে যায় বাধা। আজ বিকেলে বোর্ড সভায় পরিচালকরা নতুন সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করেন আমিনুলকে। এরই মধ্যে গুঞ্জন ছড়ায় দেশ ছেড়ে চলে গেছেন ফারুক আহমেদ। তবে এক ভিডিও বার্তায় ফারুক নিজেই নিশ্চিত করেছেন এটা নিছক গুজব, ‘‘পুরোপুরি মিথ্যা কথা। যারা আমাকে নিয়ে নাটক তৈরি করেছে এতদিন, তাদেরই একটা নাটকের শেষ অংশ মনে হচ্ছে এটা। আমি দেশেই আছি, গুজবে কান দিবেন না। আমি আগামীকাল একটি সংবাদ সম্মেলন করার চেষ্টা করছি।''
প্রশ্ন হচ্ছে এই পালাবদলের খেলায় কি বেশি তাড়াহুড়া করে ফেলা হলো? তাতে কি আইসিসির নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা থাকছে না? আইসিসি, ফিফার মতো সংস্থাগুলো বোর্ডে সরকারি হস্তক্ষেপ মানে না কোনোভাবে। সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের মতো ফুটবল ফেডারেশনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ফিফা।
-- আইসিসির নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা কতটা?--
এর আগে, বোর্ডে সরকারের হস্তক্ষেপের অভিযোগে পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডকেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আইসিসি। ফারুক আহমেদকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় না দিয়ে সরিয়ে দেওয়াটা কি সরকারি হস্তক্ষেপের আওতায় পড়বে? এ নিয়ে ডয়চে ভেলে'র সঙ্গে কথা বলেছেন বিসিবির সাবেক পরিচালক ও গঠনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর।
আইসিসির কাছে ফারুক আহমেদের অভিযোগ জানানোর কথা উল্লেখ করে সিরাজউদ্দিন বললেন, ‘‘ফারুক আহমেদকে যে প্রক্রিয়ায় অপসারণ করা হয়েছে সেটার কোন অপশন আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের গঠনতন্ত্রে নেই। আমি শুনেছি ফারুক সাহেব আইসিসির কাছে অভিযোগ করেছেন, এই অভিযোগের ভিত্তিতে আইসিসি যদি আমাদের বোর্ডের বিপক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়, কোনো অবরোধ বা যদি নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে ফাইনালি ক্রিকেটটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পরিচালকরা অনাস্থা জানালেই কি পদ হারাতে পারেন বিসিবি সভাপতি বা তাকে এনএসসি থেকে অপসারিত করা যায়? এ নিয়ে সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর বললেন, ‘‘আমি ক্রিকেট বোর্ডে ২৫-৩০ বছর সম্পৃক্ত আছি। এভাবে কারও প্রতি অনাস্থা আনার নজির নেই। এটা একটা খারাপ উদাহরণ হলো। আজকে এক ব্যক্তির বিপক্ষে হল কালকে অন্য জনের বিপক্ষেও হতে পারে।’’
তিনি এর ব্যাখ্যায় বললেন, ‘‘আমাদের গঠনতন্ত্রে যেটা আছে আমি যদি সেই ধারা অনুযায়ী বলি তাহলে একজন কাউন্সিলরকে কোনোভাবে সরানোর সুযোগ নেই। কয়েকটা ধারা আছে সরানোর, যেমন তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে, তাঁকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হতে হবে, তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এরকম তিন চারটা কারণ ছাড়া কাউকে অপসারণের সুযোগ নেই, তা তিনি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদসহ যে কোনো ক্যাটাগরি থেকেই মনোনীত হন না কেন। বোর্ড সভাপতি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করেন তাহলে তার প্রতি অনাস্থা আনার কোনো বিধানই আমাদের গঠনতন্ত্রে রাখা হয়নি।’’
ফারুক আহমেদ অভিযোগ না করলেও তাকে সরিয়ে দেওয়াটা খতিয়ে দেখবে আইসিসি। তারা যদি সরকারি হস্তক্ষেপে ফারুক আহমেদকে সরিয়ে দেওয়ার প্রমাণ পায় তখন সেটা নিষেধাজ্ঞার কারণও হতে পারে বিসিবির জন্য।
