শিরোনাম
◈ শেখ হাসিনার দুঃশাসনে খালেদা জিয়ার ওপর নেমেছিল নিপীড়নের ঝড়: তারেক রহমান ◈ মনোনয়ন পেলেন বিএনপির ১১ নারী প্রার্থী, কে কোন আসনে? ◈ পর্তুগালের নতুন আইন, অভিবাসীদের জন্য দুঃসংবাদ  ◈ নির্বাচনের তফসিল এখনো চূড়ান্ত নয়—গণমাধ্যমকে সতর্ক করলেন ইসি সচিব ◈ ব্রাদার্স ইউ‌নিয়ন‌কে ৫-১ গো‌লে হারা‌লো বসুন্ধরা কিংস  ◈ নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের কর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়  'ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ'  ◈ একইদিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট: প্রস্তুত ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্র, ঝুঁকিপূর্ণ ৮ হাজারের বেশি ◈ কাতার নয়, খালেদার জন্য জার্মানি থেকে আসছে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ◈ চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করলেই খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়া হবে: মির্জা ফখরুল ◈ দুর্যোগ মোকাবিলায় ভলান্টিয়ারদের ভূমিকা শক্তিশালী করতে সরকারের নতুন পরিকল্পনা

প্রকাশিত : ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৬:১৭ বিকাল
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১০:০৮ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের কর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়  'ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ' 

এল আর বাদল : পাঁচ অগাস্টের পর একদিনই ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন একটা পরীক্ষায় অংশ নিতে, কিন্তু সেদিনই 'শিকার হন হামলার'। পরীক্ষা তো দিতেই পারেননি, বরং মামলার আসামি হয়ে জেল খাটতে হয়েছে সাতাশ দিন।

গত দেড় বছর ধরে ক্লাস-পরীক্ষা কোনোটিতেই অংশ নিতে পারছেন না দাবি করে এই কথাগুলো বলছিলেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া খাতুন (ছদ্মনাম)।

"আমি ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম এটা ক্যাম্পাসের সবাই জানতো। ফলে আমি পরীক্ষা দিতে আসার কথা বিভাগে আগেই জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা নিরাপত্তা দিতে পারবেন না বলে আমাকে জানান। আমি মবের শিকার হলে থানায় নেওয়া হয়। পরে বিএনপি অফিসের একটা বিস্ফোরক মামলায় জেলে পাঠানো হয়," বলছিলেন তিনি। ------ সূত্র, বি‌বি‌সি বাংলা

মিজ খাতুন জানান, জেল থেকে জামিন পাওয়ার পর তিনি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। এখন তার শিক্ষাজীবনই অনিশ্চিত।

"ধরেন আমি অপরাধী, কিংবা বুঝলাম যে আমার একটা শাস্তি হয়েছে। যদি এ রকমটাও হত তাহলেও এই যে লম্বা সময়, সেটা আমার নষ্ট হতো না। আমার তো বয়স আটকায় নেই। কিন্তু আমি অনার্স শেষ করতে পারছি না। আমি কি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরুর অপেক্ষায় থাকবো, নাকি নতুন করে অন্য কোথাও ভর্তি হবো সেটাও বুঝতে পারছি না," বলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের এই কর্মী।

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না বলে অভিযোগ করছেন সুমাইয়ার মতো বহু শিক্ষার্থী যারা মূলত নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

তাদের কাউকে কাউকে জুলাই আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। আবার অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত চললেও সেই প্রক্রিয়া ঝুলে আছে মাসের পর মাস।

ফলে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রায় দেড় বছর পরও এসে দেখা যাচ্ছে, অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে, যদিও তারা কেউই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হননি।

বহিস্কার না হয়েও 'অনানুষ্ঠানিক বহিস্কার' 

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েগুলো থেকে গত পাঁচই অগাস্টের পরে কত সংখ্যক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই।

তবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর গত জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১২৮ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিলো।

আর সর্বশেষ গত নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ৪০৩ জন শিক্ষার্থীকে কেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে না তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।যেখানে এর আগে সাময়িক বহিষ্কার করা ১২৮ জনকেও রাখা হয়।

শোকজ নোটিশ পেয়েছেন এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিতে আছেন এরকম একজন শিক্ষার্থী পরিচয় প্রকাশ না করে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শোকজ নোটিশের জবাব দিয়েছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শোকজ নোটিশে দেখা যায় ওই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, ২০২৪ সালের ১৫ই জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপর তিনি 'ইট, কাঁচের বোতল, লাঠি, রামদা, আগ্নেয়াস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে হামলা চালান'।

নোটিশে বলা হয়, তার বিরুদ্ধে 'হেলমেট পরে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে'। যদিও নোটিশ পাওয়া শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা এসব অভিযোগ অস্বীকার করছেন।

"আমি লিখেছি যে, এরকম অভিযোগের কোনো প্রমাণাদি আমার বিরুদ্ধে নেই এবং আমি কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম না। সুতরাং আমাকে যেন সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে আমার শিক্ষাজীবন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে আমি শোকজের জবাব দিয়েছি, কিন্তু কোনো রিপ্লাই নেই," বলেন সেই শিক্ষার্থী।

তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া যাচ্ছে না প্রায় ১৬-১৭ মাসম ধরে। ফলে তিনি কাগজে-কলমে বহিষ্কার না হয়েও 'অনানুষ্ঠানিকভাবে' বহিষ্কারই হয়ে আছেন।

মামলা নেই, তবু বন্ধ ক্লাস-পরীক্ষা 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষার্থীও অনেকে আছেন যাদের নামে কোনো মামলা নেই, তাদের বহিষ্কারও করা হয়নি, এমনকি শোকজ নোটিশের তালিকাতেও নেই। কিন্তু এরপরও 'হুমকি-ধমকির কারণে' ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না তারা।

আর হুমকির মূল কারণ তারা ছাত্রলীগ করতেন কিংবা কমিটিতে ছিলেন। এরকমই একজন শিক্ষার্থী আনিসুর রহমান, তার ক্ষেত্রেও ছদ্মনাম ব্যবহার করা হচ্ছে।

"ধরেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তো অনেকজনকেই বহিষ্কার করা হয়েছে। সেখানে কিন্তু আমার নাম নাই। ইভেন বিশ্ববিদ্যালয় যাদের নামে মামলা করেছে সেখানেও আমার নামে কেউ অভিযোগ করেনি, আমার নামও নেই। কিন্তু এরপরও ক্যাম্পাসে যেতে পারছি না"।

আনিসুর রহমান জানাচ্ছেন, তিনি ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর জন্য বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু শিক্ষকরা 'কোনো ব্যবস্থা নেননি'।

"শিক্ষকরা বলছে যে, তুমি এখন ডিপার্টমেন্টে আইসো না। আমি স্যারদের বলছি যে, স্যার আমার নামে তো কোনো অভিযোগ নেই, কোনো প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেনি। তাহলে আমি কেন পড়াশোনা অফ (বন্ধ) দিবো। তখন শিক্ষকরা বললো যে, আমাদের একটু সময় দেও। যদি তুমি ক্যাম্পাসে মব কালচারের শিকার হও সে দায়ভার আমরা নিতে পারবো না"।

আনিসুর রহমানের ভাষায়, এরপর তিনি আর 'নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে' ক্যাম্পাসে যাওয়ার সাহস করেননি।

"টিচাররা এখনো আমাদের আসলে কোনো সমাধান দেয়নি। তারা শুধু বলে যে, একটু অপেক্ষা করো। কিন্তু এই অপেক্ষা করতে করতে দেড়টা বছর চলে গেছে," আক্ষেপ করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় কেন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না? 

বাংলাদেশে রাজনীতির পট পরিবর্তন হলে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে হামলা-মারধরের শিকার হন এটা বহু পুরোনো চিত্র।

বিগত ১৬ বছরে ছাত্রলীগ কিংবা এর আগে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে এমন বহু অভিযোগ আছে।

বিশেষ করে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

সেসব ঘটনায় তদন্ত বা আইনি ব্যবস্থা যেমন একটি দিক, আরেকটি দিক হচ্ছে শিক্ষার আইনি অধিকার থেকে যেন কেউ যেন বঞ্চিত না হয় সেটা নিশ্চিত করা, বলছেন অনেকে।

কিন্তু সেটা হচ্ছে না। কারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই ক্যাম্পাসে যাচ্ছেন না 'নিরপাত্তার অভাবে'। বিশেষ করে পরীক্ষা কিংবা ক্লাস করতে গিয়ে এর আগে কেউ কেউ হামলার শিকার হওয়ায় এই নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, কোনো শিক্ষার্থী যদি মামলার আসামি হয়ে জেলেও থাকে, তারপরও সে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী জেলে বসে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে।

"নিপীড়ন বা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিচার হতেই হবে। কিন্তু এর পাশাপাশি শিক্ষার যে অধিকার, তার ক্লাস-পরীক্ষার যে অধিকার সেটাও তাকে দিতে হবে। এর ভিন্ন কিছু করার সুযোগ নেই," তিনি বলেন। তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

"বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কিন্তু আমি দেখেছি যে, এ ধরনের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে তারা যেন নিরাপদে ক্লাস-পরীক্ষা দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার বদলে যারা ক্লাস-পরীক্ষা দিতে এসেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে যখন মব হয়েছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরং তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে"।

এটাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর 'প্রশাসনিক দুর্বলতা' এবং পূর্বের ধারাবাহিকতার অনুসরণ হিসেবেই তিনি দেখছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন বৈধ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা একটা বড় প্রশ্ন।

যদিও একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একেকরকম পরিস্থিতি। কিন্তু কোনোটাতেই ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এমন শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়নি।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে অবশ্য সক্ষমতার ঘাটতির কথা বলেছেন।

"এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধরুন এক হাজার বা পাঁচশত শিক্ষার্থী এরকম থাকতে পারে। কিন্তু পাঁচশত শিক্ষার্থীকে আলাদা আলাদা নিরাপত্তা দেওয়ার মতো কোনো মেকানিজম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। এখন আমাদেরকে যদি কেউ অবহিত করে যে, স্যার আমি আজকে পরীক্ষা দিতে যাবে, তখন আমরা ব্যবস্থা নেই এবং এভাবে অনেকের পরীক্ষা নিয়েছি। কিন্তু শেষপর্যায়ে এসে আমরা সেটা পারিনি তথ্যগুলো ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে"।

আহমেদ অবশ্য জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় যাদের শোকজ করেছে, সেই শোকজের প্রক্রিয়া শেষ হলে এমনিতেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

"তখন আমরা জানতে পারবো কারা অপরাধী, কারা অপরাধী নয়। কেউ হয়তো বহিষ্কার হতে পারেন, কারো হয়তো ছয় মাসের বা এরকম সময়ের মাসয়িক বহিষ্কারাদেশ হতে পারে। অথবা কাউকে হয়তো শুধু সতর্ক করে দেওয়া হতে পারে। যাদের অপরাধ প্রমাণ হবে না, তারা শাস্তি পাবেন না"।

কিন্তু এই প্রক্রিয়া কবে শেষ হবে জানতে চাইলে সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই এটা শেষ হতে পারে এবং এই তালিকায় পরে আর নতুন কেউ যুক্ত হবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়